★স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের ব্যাঘাত Interruption of Cycle of Erosion
কোনো একটি ক্ষয়চক্রের যৌবন, পরিণত ও বার্ধক্য অবস্থা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই ভূ-আন্দোলনের ফলে এই ক্ষয়চক্রের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। আবার ওইখানে পুনরায় ভূমিভাগ উত্থনের শেষে নতুন আরেকটি ক্ষয়চক্র শুরু হতে পারে। ডেভিস বর্ণিত স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের শেষ পর্যায়ে সমপ্রায়ভূমির সৃষ্টির মাধ্যমে অনেক সময় স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের যেকোনো অবস্থায় বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এই বাঁধাগুলিকে ডেডিস তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Geographicl Essays'-তে দুটি প্রকার দেখিয়েছেন, যথা-(i) ক্ষয়কার্যের শেষে উচ্চতর পরিবর্তন; (ii) জলবায়ুর পরিবর্তন, এছাড়াও অনেকে আগ্নেয় লাভার উদ্গিরণকে কিংবা ক্ষয়ের শেষসীমার পরিবর্তনকেও বাধা হিসাবে দেখিয়েছেন। নিম্নে এগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করা হল
1.) ক্ষয়ের শেষসীমার পরিবর্তনগত বাধা (Eustatic Change of Sea level Interruption): ক্ষয়ের শেষসীমার পরিবর্তন দুই প্রকার যথা ঋণাত্মক পরিবর্তন (Negative Change of Sea level) ও ধনাত্মক পরিবর্তন (Positive Change of Sea level) জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কিংবা ভূমিরূপের উত্থান বা অবনমনের জন্য কয়ের শেষসীমা বা সমুদ্র তলের পরিবর্তন ঘটতে পারে। অর্থাৎ ভূমিভাগ উঁচু হয়ে উঠলে কিংবা সমুদ্রের জল মহাদেশের ভূভাগে বরফ হিসেবে সজ্জিত হলে সমুদ্রপৃষ্ঠ নীচু হয়ে যেতে পারে, সমুদ্রপৃষ্ঠের এই ধরনের পরিবর্তনকে ঋণাত্মক পরিবর্তন বলে। এই ধরনের পরিবর্তন ঘটলে ক্ষয়চক্রের সময়সীমা বেড়ে যায়। এবং এই ধরনের পরিবর্তন ক্ষয়চক্রের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে, আবার মহাদেশীয় ভূভাগের উপর অবস্থানরত বরফ গলে গেলে মহাদেশীয় ভূভাগ অবনমিত হয়ে যায়, যার ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠ অপেক্ষাকৃত উঁচু হয়ে ওঠে। এই ধরনের বিবর্তনকে ধনাত্মক পরিবর্তন বলে। ক্ষয়চক্রের শেষসীমায় এই ধরনের পরিবর্তন ঘটলে ক্ষয়চক্রের সময়সীমা স্বল্পতর হয় এবং এই পরিবর্তন পলি সময়ের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।
2.) জলবায়ু সংক্রান্ত বাধা (Climatic Interruption) : জলবায়ুর পরিবর্তনের জন্য ক্ষয়চক্রে বাধা ঘটতে পারে। জলবায়ুর পরিবর্তন দুপ্রকার। যথা- (a) মরুদেশীয় জলবায়ুর আগমন (Imposition of arid climate) এবং (b) হিমবাহযুক্ত জলবায়ুর আগমন (Imposition of glacial climate) চলাকালীন কোনো অঞ্চলে জলবায়ুর পরিবর্তন হতে পারে এবং জলবায়ু পরির্তনের ফলে ভূপৃষ্ঠ প্রবাহ ও নদীপ্রবাহের পরিমাণ কমে যায় বা বেড়ে যায়, সেই সঙ্গে শিক্ষার উদভেদের প্রকৃতির পরিবর্তন কিংবা আবহাওয়ার প্রকৃতির পরিবর্তনে আবহবিকারের তীব্রতার পরিবর্তন ঘটতে পারে। এই সমস্ত কারণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়ার তীব্রতার পরিবর্তন ঘটে। সেই সঙ্গে কয়চক্র বাধাপ্রাপ্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ কোনো একটি ক্ষয়চক্র আর্দ্র অঞ্চলে পরিণত পর্যায়ে অবস্থান করছে অথচ হঠাৎ করে যদি সেই অঞ্চলে জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা যায়, তাহলে অঞ্চলটি শুষ্ক বা শীতল জলবায়ুতে পরিণত হয় এবং ফলে নতুনভাবে ক্ষয়চক্র শুরু হবে।
3.) ভূমিভাগের উত্থানজনিত পরিবর্তনগত বাধা (Dynamic Change Due to Upliftment Interruption) : ভূমিরূপের উত্থানের কারণে ক্ষয়চক্রে বাধার সৃষ্টি হয়। আর্থাৎ কয়চক্র চলাকালীন কোনো নদী অববাহিকার ভূমিরূপ উঁচু হয়ে উঠলে স্বাভাবিকভাবে তা নদী চলার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভূমির উচ্চতা বাড়লে নদীর স্থিতিশক্তি ও গতিশক্তি বাড়ে। নদীর নিম্নক্ষয়ের হার উত্থানের হারের তুলনায় বেশি বা সমান হালে নদী তার প্রবাহ বজায় রাখতে পারে। ভূমির উত্থানের আগে নদীর উত্থান হয় বলে এই ধরনের নদীকে পূর্ববর্তী নদী বলে। এই ধরনের নদী উপত্যকায় ক্ষয়চক্রের সমস্ত পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। আবার ভূমিভাগের উত্থানের ফলে ভূতাত্ত্বিক গঠনের যে পরিবর্তন হয়, তার সঙ্গে দ্রুত নিম্নক্ষয় করতে থাকে। নদীর সামঞ্জস্য থাকে না। ভূতাত্ত্বিক গঠনের সাথে অসামঞ্জস্যহীন এই নদীকে অধ্যারোপিত (superimposed) নদী বলে। ক্ষয়চক্রের এইরূপ পরিবর্তনে নদীর শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং নদী তার পূর্ববর্তী মসৃণ ভূমিরূপকে নতুন করে ক্ষয় করতে শুরু করে। তাই এইরূপ অবস্থাকে ক্ষয়চক্রের পুনর্যৌবনলাভ (rejuvenation) বলে। এই ধরনের অবস্থায় নদী অববাহিকার ভূমিরূপে কতকগুলি বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, এর ফলে নিক পয়েন্ট (nick point) উপত্যকা, মধ্য উপত্যকা (valley in valley) প্রভৃতি ভূমিরূপ, লক্ষ করা যায়। সেই সঙ্গে সমগ্র উপত্যকায় নতুন ক্ষয়চক্রের সূচনা হয়।
4.) অগ্নদগমজনিত বাধা (Volcanic Interruption) : কোনো বৃহৎ অঞ্চলে বিস্ফোরণ ছাড়াই যদি লাভা উদগিরণ করে তাহলে সমগ্র অঞ্চলটি ব্যাসন্টিক লাভা রূপে পতিত হয়। সেই সঙ্গে ওই অঞ্চলে জলনির্গম ব্যবস্থা বাধা পাবে ও পূর্বের ভূমিরূপ ঢাকা পড়ে যাবে, ফলস্বরূপ ওই অঞ্চলে ক্ষয়চক্র বাধাপ্রাপ্ত হবে। যদি ওই অঞ্চলে লাভার উদ্গিরণ বন্ধ হয়, তাহলে শীতল লাভা জমাট বেঁধে নতুন ভূমিভাগ গড়ে উঠবে, সেই সঙ্গে ওই অঞ্চলে জলধারার প্রবাহ গড়ে উঠলে পুনরায় ওই অঞ্চলে নতুনভাবে ক্ষয়চক্রের সৃষ্টি হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ভারতের দাক্ষিণাত্য মালভূমি অঞ্চলে লাভার উদ্গিরণের ফলে জুরাসিক ক্ষয়চক্র প্রায় সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে লাভা প্রবাহ বন্ধ হয়ে এবং ভূমিভাগ গঠন করে মৌসুমি জলবায়ুর দ্বারা ক্ষয়চক্র শুরু হয় টার্শিয়ারি যুগে।
5.) স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের লেখচিত্রের বিশ্লেষণ (Graph Analysis of Normal Cycle of Erosion) : দীর স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের ধারণা সম্পর্কে M. M. Davis একটি লেখচিত্র ব্যবহার করেছেন, যা সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যন অনুযায়ী উচ্চতার যে তারতম্য লক্ষ করা গেছে, তা দেখানো হয়েছে। এই লেখচিত্রে দুটি আলাদা রেখা দ্বারা প্রাথমিক ভূমির দ্রুত উত্থানকে দেখানো হয়েছে। ভূমির উচ্চতম অংশ ও নিম্নতম অংশের মধ্যেকার উচ্চতাই ভূমির বন্ধুরতার পরিমাপ। এই পরিমাণ দেখেই বোঝা যায় ভূমিরূপটি কোন পর্যায় আছে। সাধারণত ভূমি যতই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগোয় ততই বন্ধুরতা কমতে থাকে। একটি আদর্শ ক্ষয়চক্রের যৌবন পর্যায়ে নদীর জলের দ্বারা বেশি পরিমাণে নিম্নক্ষয়ের দরুন উপত্যকাগুলি তাড়াতাড়ি গভীরতা লাভ করে ভূমির গড় বন্ধুরতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু এই পর্যায়ে জলবিভাজিকাগুলি বিশেষ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় না, অর্থাৎ লেখচিত্রে দুটি রেখার মধ্যে দূরত্ব বৃদ্ধি ভূমির বন্ধুরতা বৃদ্ধিকে নির্দেশ করছে। ক্ষয়চক্রের পরিণত পর্যায়ের প্রথমভাগে ভূমির সর্বাধিক বন্ধুরতার পরিমাণ। ভূমির বন্ধুরতা সর্বাধিক লাভ করার পর উপত্যকার তলদেশে নিম্নক্ষয়ের হার খুব কমে যায়, সেই সঙ্গে বিভাজিকাগুলির উচ্চতা দ্রুত গতিতে হ্রাস পেতে থাকে। এই দ্রুত ক্ষয় পাওয়ার দরুণ লেখচিত্রের লেখাদুটি পরস্পরের কাছে অবস্থান করতে থাকে। ক্ষয়চক্রের বার্ধক্য পর্যায়ে নদীর কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ায় লেখচিত্রে রেখাদুটি খুব ধীরে ধীরে পরস্পরের কাছে আসতে থাকে। তত্ত্বগতভাবে লেখচিত্রের শেষের দিকে ডান দিকে যতই যাওয়া যায়, রেখাদুটি পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর ক্ষয়চক্রটি সম্পূর্ণতা লাভ করে।