★স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের মূল্যায়ন Evaluation of the Normal Cycle of Erosion
1899 সালে প্রবর্তিত ডেভিসের স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র' মতবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন ভূ-বিজ্ঞানী দ্বারা সমালোচিত হলেও ভূমিরূপ বিবর্তনে এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। নিম্নে এই তত্ত্বের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিভিন্ন বিজ্ঞানী দ্বারা আলোচিত হয়েছে, তা আলোচনা করা হল
(i) ডেডিস প্রবর্তিত ক্ষয়চক্রের মডেলটি সরল এবং সহজেই যেকোনো অঞ্চলে প্রয়োগ করা যায়। অর্থাৎ, এই সারল্য ডেভিসের মডেলের একমাত্র উল্লেখযোগ্য গুণ।
(II) ডেভিস তাঁর স্বাভাবিক চক্রের মডেলটি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণের (field observation) দ্বারা গড়ে তুলেছেন।
(ill) এই মডেলটিকে নদীবিন্যাস যুক্ত অঞ্চল, হিমবাহ অধ্যুষিত অঞ্চল, চুনাপাথর গঠিত অঞ্চল, উপকূল অঞ্চল, কিংবা মরু অঞ্চলের ভূমিরূপের গঠন, বিবর্তন ও বিকাশ অনুসন্ধানে প্রয়োগ করা যায়।।
(iv) ডেভিসের উপস্থাপন খুব সাবলীল, গ্রহণীয় এবং আকর্ষণীয়। তাই ভূ-বিজ্ঞানী ব্রায়ান-এর মতে, ডেভিসের সরল ও কার্যকরী মডেলটির উপস্থাপনাই মডেলটিকে সর্বস্তরে গ্রহণীয় করে তুলেছিল।
(v) মডেলটিতে প্রথম বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহায্যে ভূমিরূপের বিবর্তন তথা ক্ষয়চক্রের ধারণা আলোচিত হয়েছে।
(vi) ডেভিস তাঁর ক্ষয়চক্রের মডেলটি ওই সময়ে প্রচলিত ভূতাত্ত্বিক চিন্তাধারা ও প্রসঙ্গগুলিকে একত্রিত করে সহজ সরল পরীক্ষিত তত্ত্বরূপে প্রকাশ করেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গিলবার্টের পর্যায়িত তত্ত্ব (graded base level theory). ফরাসি ভূ-তত্ত্ববিদ অ্যাগাসিজ ও প্রেফেয়ার এর সাম্য অবস্থার প্রস্থচ্ছেদ (profile equilibrium) প্রভৃতি তত্ত্বের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তাঁর নিজের ক্ষয়চক্র তত্ত্বটি সহত্য ও পরিষ্কার ভাষায় উপস্থাপন করেছেন।
(vii) ডেভিসের মডেলটি সহজেই যেকোনো অঞ্চলে প্রয়োগ বা বিচার করা যায়। ভূমিরূপের অবস্থাগুলিকে তাঁর তিনটি পর্বের ক্ষয়চক্রের মডেল দ্বারা ঐতিহাসিক বিবর্তনকে (historical evoluation) ব্যাখ্যা করা যায়।
(viii) হার্টনের লিখিত বই 'Cyclic Nature of the Earth History' প্রকাশের দীর্ঘ সময় পর ডেভিসের মতবাদ ভূমিরূপ বিবর্তনের একটি সাধারণ তত্ত্ব হিসাবে অধিক জনপ্রিয় হয়েছিল।
● সমালোচনা (Criticism) বিংশ শতাব্দীর প্রায় সমগ্র প্রথম ভাগ জুড়ে ভূমিরূপবিদ্যার আলোচনার ক্ষেত্রে ডেভিসের মতবাদ এক নবদিগন্তের সূচনা করলেও বহু ভূমিরূপ বিজ্ঞানী এই মতবাদের বিরূপ সমালোচনা করেছেন, অর্থাৎ এই মতবাদটিকে ভূ-বিজ্ঞানীগণ পেক (W. Penck), কিং (L. C. King. 1952), থাক (J. T. Hack, 1942) ক্লিকম (Crickmay, 1960) চোৱলে (Chorley, 1961) প্রভৃতি তাঁদের মতবাদ দিয়ে কয়েকটি গাঠনিক সমস্যা নিয়ে সমালোচনা ও সেই সঙ্গে বিপরীত মডেলগুলির প্রস্তাব করেন। সেগুলি নিয়ে আলোচনা করা হল
(i) ডেভিসের মডেলে ক্ষয় শুরু হওয়ার পূর্বে ভূভাগের উত্থান হওয়া এবং দীর্ঘসময় ধরে ভূমিভাগ সুস্থিত থাকার ব্যাখ্যা মেনে নেওয়া যায় না। কোনো ভূমিভাগ দ্রুত উত্থিত হয়ে দীর্ঘ সময় সুস্থিত থেকে ক্ষয়চক্রাকে সম্পূর্ণ করার মতো দীর্ঘ সময় ধরে অপরিবর্তিত থাকে না। ভূমিভাগ ক্ষয়প্রাপ্ত হলে তা হালকা হয়ে সমস্থিতির কারণে আরও উত্থিত হবে এটাই স্বাভাবিক।
(II) ডেভিসের মতবাদ অনুযায়ী একটি স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের শেষ পর্যায়ে এক সমাপ্রায় ভূমির উদ্ভব হয়। কিন্তু সমালোচকগণ মনে করেন যে সমপ্রায় ভূমি সৃষ্টির জন্য দীর্ঘ সময় প্রয়োজন এবং এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ক্ষয়সীমা এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে ক্ষয়চক্রের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। তাই স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়।
(iii) ডেভিসের মতে, কোনো একটি নির্দিষ্ট ক্রম (order) এবং পর্যায় (stage) অনুসারে ভূমিরূপ বিবর্তিত হবে অর্থাৎ ভূমিরূপের বিকাশ বা বিবর্তন সময় দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, কিন্তু ভূবিজ্ঞানী পেঙ্ক ও হ্যাকের মতে, ভূমিরূপের বিবর্তন সময়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে ভূমিভাগের উত্থানের সঙ্গে সংগতি না রেখে ভূমিরূপের বিকাশ ঘটায়।
(iv) ডেভিস তাঁর স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রে ভূমিরূপ গঠনে যৌবন, পরিণত ও বার্ধক্য অবস্থার উল্লেখ করেছেন, কিন্তু শিলার ধান অনুসারে যে ভূমিরূপ আলাদা হতে পারে, সেটা তিনি উল্লেখ করেননি।
(v) ডেভিস তাঁর স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রে মতামত প্রকাশ করেছেন যে, দুটি নদীর মধ্যবর্তী উচ্চভূমিটি দুদিক থেকে নদীর পার্শ্বক্ষয়ের ফলে জলবিভাজিকার উচ্চ অংশ ক্রমশ ক্ষাপ্রাপ্ত হতে হতে শেষ পর্যায়ে সমতল ভূমিতে পরিণত হয়, কিন্তু ভূমিরূপ বিজ্ঞানী পেঙ্কের মতে, দুই নদী মধ্যবর্তী জলবিভাজিকাটি ঢাল অনুসারে সমান্তরাল ভাবে পিছনে ফিরে যাওয়ার বৈশিষ্ট্যের জন্য ক্ষয়ে যায়।
(vi) স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রের ক্ষেত্রে ভূভাগ দ্রুত উত্থিত হলে নদীগুলি অধিকমাত্রায় নিম্নক্ষয় করে উত্তল ঢালযুক্ত V’ আকৃতির নদীখাত গঠন করে। যদি ভূমিভাগের উত্থানের হার ক্রমশ কম হয়, তাহলে নদী নিম্নক্ষয়ের বদলে পার্শ্বক্ষয় বেশি করে, নদী উপত্যকাকে আরো বেশি প্রশস্ত করবে। আবার যদি ভূমিভাগের উত্থানের হার সমান থাকে, সেক্ষেত্রে নদীগুলি একই আকৃতির নদী উপত্যকাতে কোনো পরিবর্তন না ঘটিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করবে। এক্ষেত্রে সময়ের সাথে আকৃতি পরিবর্তনের কোনো সম্পর্ক লক্ষ করা যায় না।
(vii) হ্যাকের মতে প্রাকৃতিক শক্তিগুলি সর্বদা পরিবর্তন হচ্ছে এবং ভূমিরূপ সেই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটা ভারসাম্য বজায় রাখে। ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ, উচ্চতা, ঢালের ধরন, প্রাকৃতিক শক্তির প্রকৃতি প্রভৃতির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে, এদের মধ্যে যেকোনো একটির পরিবর্তন হলে অপরগুলিও পরিবর্তিত হয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে থাকে। এখানে পর্যায়ক্রমিক ভূমিরূপ গঠিত হয় না, অর্থাৎ ক্ষয়চক্র বলে বাস্তবে কিছু ঘটে না, ভূমির গঠন অনুসারে বিভিন্ন জায়গায়। বিভিন্ন ভূমিরূপ সৃষ্টি করে।
(vill) ডেভিস তাঁর আদর্শ ক্ষয়চক্রকে ভূমিভাগের বিবর্তনে ভূতাত্ত্বিক গঠন এবং অবক্ষয় মাধ্যম প্রভাবকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। সমূহের পার্থক্যজনিত
(ix) ডেভিস তাঁর স্বাভাবিক ক্ষয়চক্রে ভূমিভাগের বিবর্তন এবং ভূমিরূপ গঠনের ক্ষেত্রে উদ্ভিদ প্রাণী, মৃত্তিকা এবং মানুষের কার্যাবলির যে প্রভাব রয়েছে, সেই প্রসঙ্গে কোনো কথা উল্লেখ করেননি।