আবহবিকার Weathering
• ধারণা ( Concept ) ভূমিরূপের পরিবর্তন ঘটাতে ভৌত পদ্ধতিগুলির মধ্যে আবহবিকার অন্যতম । আবহবিকার কথাটি আবহাওয়া থেকে এসেছে । কাজেই আবহবিকার বলতে আমরা বুঝি আবহাওয়ার যারা ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন সাধন । অর্থাৎ আবহবিকার হল । এমন এক ধরনের রূপান্তর প্রক্রিয়া যার সাহায্যে শিলা , মৃত্তিকা প্রভৃতি ভেঙে চূর্ণ - বিচূর্ণ হয়ে ভূপৃষ্ঠের উপরেই পড়ে থাকে । আবহবিকার একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া , যা মাটি সৃষ্টির প্রাক্ প্রক্রিয়া হিসেবে মনে করা হয় । এই প্রক্রিয়ার দ্বারা শিক্ষা ভেঙে ছোটো ছোটো খণ্ডে ও চূর্ণে পরিণত হয় । এই খণ্ড বা চূর্ণগুলি পরবর্তী সময়ে মাটির উৎপত্তিতে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে । আবহবিকারের ফলে ভূপৃষ্ঠের কঠিন শিলা নমনীয় ও বিয়োজিত হয়ে চূর্ণ - বিচূর্ণ হলেও , বিয়োজিত বস্তুর কোনো স্থান পরিবর্তন হয় না । তাই এটি একটি স্থিতিশীল প্রক্রিয়া । সেই সঙ্গে এটি একটি জটিল প্রক্রিয়া ।
● সংজ্ঞা ( Definition ) Chorley- এর মতে “ আবহবিকার শিলা ও খনিজের আবহাওয়ার উপাদানের সংস্পর্শতলের অবক্ষ্যা ও অসংবন্ধ " হওয়াকে নির্দেশ করে । Monkhouse- এর মতে আবহবিকার হল শিলার স্থিতিশীল অবস্থায় বিসংযুক্তিকরণকে বোঝায় । ডুবিজ্ঞানী স্পার্ক - এর মতে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন শিলাসমূহকে প্রাকৃতিক শক্তির মাধ্যমে যান্ত্রিকভাবে ভেঙে ও রাসায়নিক ভাবে বিরোজিত করে পরিবর্তিত করার প্রক্রিয়াগুলিই হল আবহবিকার । বিখ্যাত ভূ - বিজ্ঞানী ডব্লু . ডি . ধর্নবেরির মতে " আবহবিকার হল কোনো শিলার নিজস্থানে বিচূর্ণন বা বিয়োজন ( weathering may be defined as the desintegration of dicomposition of rock in place . ) ! বিজ্ঞানী সি . ডি . ওলেয়ারের ( 1974 ) মতে “ ভূপৃষ্ঠের ওপরে অবস্থিত শিলা বা খনিজের বিচুর্ণীভবন বা বিয়োজনের মাধ্যমে নতুন পরিবর্তিত ভৌত বা রাসায়নিক অবস্থায় পদার্থের অধিকতর ভারসাম্য থাকে তাকে আবহবিকার বলে ( weathering is the break down and alteration of materials near the earth's surface to products that are more in equilibrium with newly imposed physico - chemical condition . ) । আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদানের প্রভাবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় একই স্থানে থেকে শিলারাশি ভেঙে যাওয়াকে আবহবিকার বলে । আবহবিকার হল বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উপাদানের সংস্পর্শে ভূত্বকের শিলা , খনিজের গঠনগত ভাঙন ও পরিবর্তন যা কিনা ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কিংবা যেকোনো একটি প্রক্রিয়ায় হতে পারে সবশেষে বলা যায় যে — বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠের শিলা চূর্ণ - বিচূর্ণ হয় অথবা বাতাস ও জলের সংস্পর্শে হলে যায় বা দ্রবীভূত হয় । শিলাসহ খনিজের এই ধরনের চূর্ণ - বিচূর্ণ ও দ্রবীভূত হওয়ার প্রক্রিয়াকে আবহবিকার বলে ।
ভূবিজ্ঞানী স্টুলারের মতে ভূপৃষ্ঠের ওপরে বা নিকটে উন্মুক্ততার জন্য যে সমস্ত প্রক্রিয়ায় শিলা বাহিকভাবে চূর্ণ - বিচূর্ণ হচ্ছে এবং রাসায়নিক ভাবে বিয়োজিত হচ্ছে তাদের সম্মিলিত কাজকেই আবহবিকার বলে ( weathering is the general form to the combined action of all processes causing rock to be disintegrated physically and or decomposet chemically because of exposure at or near earth's surface . ) । পি . রিচি ( P. Riche , 1950 ) -এর মতে কোনো শিলা বা খনিজ যেটি আগে শিলামণ্ডলের গভীরে ভারসাম্য অবস্থায় ছিল , কিন্তু পরবর্তীকালে সেটি উন্মুক্ত অবস্থায় বায়ুমণ্ডল বারিমণ্ডল এবং সর্বোপরি জীবমণ্ডলের সঙ্গে ক্রিয়া - প্রতিক্রিয়ার ফলে যে সাড়া দেয় কিংবা যে যে পরিবর্তন ঘটে তাকে আবহবিকার বলে ( weathering is the response of materials which were in equilibrium within the lithosphere to conditions at or near its contact with the atmosphere , the hydrosphere and perhaps still importantly , the biosphere . )
• বৈশিষ্ট্য ( Characteristics ) আধুনিক ভূ - বিজ্ঞানীদের মতে প্রাকৃতিক শক্তি এবং আবহবিকার ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগ গঠনসহ মৃত্তিকা সৃষ্টির পদ্ধতিতে সাহায্য করে । কিন্তু জলবায়ুর তারতম্য অনুসারে এদের প্রকৃতি এবং তীব্রতা ভিন্ন ধরনের হয় । আবহবিকার দ্বারা বিয়োজিত বস্তুর কোনো চলন লক্ষ করা যায় না । তাই এই প্রক্রিয়ার কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায় , সেগুলি নিয়ে আলোচনা করা হল
( i ) এই প্রক্রিয়ার দ্বারা অপ্রবেশা শিলাস্তরগুলি বিকারজাত হয়ে প্রবেশ্যতার সৃষ্টি করে , ফলস্বরূপ শিলাস্তরগুলি দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
( ii ) আবহবিকার বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত হয় । কিন্তু বিশেষ করে ক্লান্তীয় অঞ্চলে প্রবীভবন ও কৈশিক প্রক্রিয়ায় Duricrust
( iii ) আবহবিকারের দ্বারা বেশ কিছু ছোটো ছোটো ভূমিরূপ সৃষ্টি করে । আবহবিকারের ফলে শিলায় ঢিবি ( mound ) , ঢিলা ( tors ) , বিবারজাত গর্ভ ( weathering pit ) তালিকা ( box pit ) প্রভৃতি গঠিত হয় । সহজে প্রবীভূত হয়ে প্রাপ্ত হয় ।
( iv ) ক্রান্তীয় অঞ্চলে ল্যাটেরাইটে যে শম্ভু লোহ ও অ্যালুমিনিয়ামের স্তর লক্ষ করা যায় তা পরবর্তী সময়ে বিক্রিয়ার ফলে
• সংশ্লিষ্ট পদ্ধতি ( Attached Processes ) আবহবিকারের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত বিষয়বস্তুকে নীচে আলোচনা করা হল ।
■ ক্ষয়ীভবন ( Erosion ) : আবহবিকারের মাধ্যমে শিলাচূর্ণ কখনোই স্থানান্তরিত হয় না , বরং একই স্থানে জমে থাকে । আবার নদী , বায়ু , হিমবাহ , সমুদ্রতরা এই সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা শিলা ভেঙে যায় । এই ভাঙা শিলাখণ্ডগুলিকে এই সমস্ত শক্তি অন্যত্র বয়ে নিয়ে যায় । ভাঙার পর যেখানকার শিলা সেখানে থাকে না বলে একে আমরা আবহবিকার না বলে ক্ষয় ( erosion ) বলব । বিভিন্ন গতিশীল প্রাকৃতিক শক্তি দ্বারা মূল শিলা থেকে চূর্ণ - বিচূর্ণ পদার্থ অন্যত্র অপসারিত হলে ক্ষমীভবন বলে ।
■ নগ্নীভবন ( Denudation ) : আবহবিকার এবং ক্ষয়ীভবন এই দুটি প্রক্রিয়াকে একত্রে নগ্নীভবন বলে । আবহবিকার এবং তার পরে ক্ষয়ীভবন হলে মূল শিলার ভিতরের অংশ উন্মুক্ত হয় । একে নগ্নীভবন বলে । নগ্নীভবনের নীচের আবহাওয়ায় উন্মুক্ত হয় , তখন আবার সেই উন্মুক্ত শিলাস্তরে আবহবিকার শুরু হয় । অর্থাৎ ক্ষমীভবনের ফলে ক্ষরীভূত অংশ অন্যস্থানে অপসারিত হলে ভূত্বকের অবশিষ্ট অংশ আবরণহীন অর্থাৎ নগ্ন হয়ে পড়ে । এই ধরনের পরিবর্তনকে নগ্নীভবন বলে । অর্থাৎ নগ্নীভবনে নীচের শিলাস্তর আবহাওয়ায় উন্মুক্ত হয় , তখন আবার সেই উন্মুক্ত শিলাস্তরে আবহবিকার শুরু হয় ।
(‡) আবহবিকারের নিয়ন্ত্রক Controls of Weathering পৃথিবীর সর্বত্র একই ভাবে কিংবা একই মাত্রায় আবহবিকার হয় না কোথাও এর মাত্রা বেশি বা কোথাও এর মাত্রা কম । আবার এর পদ্ধতি , ধরন এবং প্রকৃতি সর্বত্র সমান নয় । এর কারগুল নিম্নরূপ
[১] শিলার উপাদান ও গঠন ( Composition and Structure of Rock ) : শিলার গঠন বলতে তার প্রাকৃতিক এবং রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যকে বোঝায় , যেমন শিলার গঠনকারী খনিজ , দারণ , ফাটল , স্তরায়ণ তল , ভাঁজ , চ্যুতি প্রভৃতি । শিলাস্তরে ধারণ বেশি হলে আবহবিকার বেশি হয় । আবার শিলাস্তরে ফাটল দেখা দিলে তার মধ্যে জল প্রবেশ করে বরফে পরিণত হলে আবহবিকার সংঘটিত হয় । কিংবা ঐ ফাটলের মধ্যে উদ্ভিদের শিকড় প্রবেশ করলে আবহবিকারের হার বেড়ে যায় । শিলায় সচ্ছিদ্রতা কম থাকলে কিংবা শক্ত প্রকৃতির হলে আবহবিকার খুব ধীরে ধীরে সংঘটিত হয় । আবার মোটা দানা যুক্ত বেলেপাথরে জল সহজেই প্রবেশ করতে পারে বলে আবহবিকার দ্রুত সংঘটিত হয় । শ্লেট শিলায় সম্ভেদ অবস্থান করায় আবহবিকারের ফলে শিলা পাতের ন্যায় উঠে আসে । সিস্টের মধ্যে অভ্র ( mica ) - এর পরিমাণ বেশি থাকলে আবহবিকার অধিক মাত্রায় সংঘটিত হয় কিংবা চুনাপাথরে বৃষ্টির জল প্রবেশের ফলে রাসায়নিক আবহবিকার লক্ষ করা যায় । কোনো স্থানে শিলার গঠন আবহবিকারকে নিয়ন্ত্রণ করে । শিলার গঠন সাধারণত শিলার স্থিতিস্থাপকতা যা শিলার মধ্যে ধারণের উপস্থিতির উপর নির্ভর করে । শিলা গঠনকারী খনিজ পদার্থ যথা ক্যালসাইট , জিপসামের সঙ্গে জল মিশে গেলে দ্রবণ প্রক্রিয়া শুরু হয় । আবার ক্যালসিয়াম , ম্যাগনেসিয়াম , পটাশিয়াম প্রভৃতিতে খনিজের পরিমাণ বেশি বলে জল ও বায়ুমণ্ডলের কার্বন ডাই - অক্সাইডের মিশ্রণে যে কার্বনিক অ্যাসিড গঠিত হয় তার প্রভাবে শিলা সহজে গলে যায় ।
[2] শিলার কাঠিন্য ও গ্রথন ( Hardness and Texture ) : শিলা গঠনকারী খনিজ পদার্থের কাঠিন্যের ওপর ভাবহবিকারের তীব্রতা এবং দ্রুততা নির্ভর করে । কোনো কোনো খনিজ খুবই কঠিন , যেমন হীরে , টোপাজ , কোয়ার্টজ প্রভৃতি যে সমস্ত শিলায় খনিজের কাঠিন্য মোহ স্কেল অনুযায়ী 7 - এর বেশি সেই শিলাগুলি সহজে আবহবিকার দ্বারা প্রভাবিত হয় না । কিন্তু যে সমস্ত শিলায় অবস্থানরত খনিজের কাঠিন্য মোহ স্কেল অনুযায়ী 7 - এর কম যেমন ট্যাল্ক , জিপসাম , ক্যালসাইট এদের দ্বারা গঠিত শিলায় আবহবিকার বেশি লক্ষ করা যায় । শিলার গ্রথন আবহবিকারকে প্রভাবিত করে । শিলায় অবস্থানরত খনিজের বিন্যাসের ওপর শিলার গ্রথন নির্ভর করে । শিলার এথন দুই প্রকার যথা — স্থূল বা সূক্ষ্ম । সূক্ষ্ম দানা দ্বারা গঠিত শিলার কেলাসগুলি পরস্পর ঘন সংঘবদ্ধভাবে থাকায় আবহবিকার ধীরে ধীরে সংঘটিত হয় । কিন্তু স্থূল প্রথন যুক্ত শিলার কণাগুলি দৃঢ় সংঘবদ্ধভাবে অবস্থান না করায় কণাগুলির জোড়া সহজে নষ্ট হয়ে যায় যা আবহবিকারকে সহজে প্রতিহত করতে পারে না ।
[3] জলবায়ু ( Climate ) : আবহবিকারের মাত্রা ও প্রকৃতি জলবায়ু দ্বারা প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রিত । জলবায়ুর প্রধান দুটি উপাদান হল তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত । পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র যান্ত্রিক আবহবিকারকে নিয়ন্ত্রণ করে জলবায়ু । মরু অঞ্চলে অত্যধিক উন্নতার জন্য কিংবা দিন রাতের মধ্যে উন্নতার পার্থক্য বেশি হওয়ায় যান্ত্রিক আবহবিকার অধিক মাত্রায় সংঘটিত হয় । উষু অঞ্চলে দিনের বেলায় উন্নতা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিলার উপরের স্তরের প্রসারণ এবং রাতে তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ায় শিলাস্তরের সংকোচন ঘটে । এইভাবে ক্রমাগত চলতে থাকলে শিলাস্তরে ফাটলের সৃষ্টি হয়ে যান্ত্রিক আবহবিকার ঘটে । টু - বিজ্ঞানী গ্রিনফিল্ড ( Greenfield ) মনে করেন যে মরু অঞ্চলে অপ্রধান খনিজের অবস্থান মনে করিয়ে দেয় যে এখানে রাসায়নিক সংঘটিত হচ্ছে । নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে সারা বছর ধরে অধিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত ও অধিক উন্নতার ফলে যান্ত্রিক ও রাসায়নিক উভয় প্রকার আবহবিকার সংঘটিত হয় । ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে দীর্ঘদিন বৃষ্টিপাতের ফলে একধরনের শুষ্ক ঋতু দেখা যায় । এই অঞ্চলে ধৌত প্রক্রিয়ায় শিলাস্তরের উপরে অবস্থিত প্রবণশীল লবণ কণা নীচে নেমে যায় কিংবা কৈশিক প্রক্রিয়ায় উপরে উঠে আসে । এভাবে ল্যাটেরাইটের সৃষ্টি হয় । সুতরাং এইভাবে ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে উভয় ধরনের রাসায়নিক আবহবিকার সংঘটিত হয় ।
[4] ভূমির ঢাল ( Ground Slope ) : কোনো অঞ্চলের ভূমির ঢাল সেই অঞ্চলের আবহবিকারকে নিয়ন্ত্রিত করে । ভূমির ঢালের ওপর জলের পরিমাণ , আবহবিকারের হার এবং আবহবিকারজাত পদার্থের অপসারণ প্রভৃতি বিষয়গুলি নির্ভর করে । রাসায়নিক আবহবিকারকে ত্বরান্বিত করার জন্য ভূমির উচ্চতা যেমন মাঝারি হওয়া প্রয়োজন , তেমনি ভূমির ঢাল মুন্ন হওয়া প্রয়োজন । আবার ভূমির ঢাল বেশি হলে যান্ত্রিক আবহবিকারের ফলে বিচূর্ণীভূত প্রস্তরখণ্ড খাড়া ঢাল বরাবর অপসারিত হয়ে নীচে পড়ে যায় এবং পুনরায় আবহবিকারের জন্য উন্মুক্ত হয় । আবার কম ঢাল যুক্ত অঞ্চলে জল নিকাশি ব্যবস্থার অবস্থানের জন্য জল মৃত্তিকার ভেতরে প্রবেশ করে রাসায়নিক আবহবিকার ঘটায় ।
[5] জীবমণ্ডল ( Organism ) : আবহবিকার নিয়ন্ত্রণে জীবমণ্ডলের গুরুত্ব অপরিসীম । বিভিন্ন ধরনের উদ্ভিদ রাশিসহ , প্রাণীর সংখ্যা এবং প্রকৃতি বিভিন্ন ধরনের আবহবিকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । উদ্ভিদের শেকড় শিলার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে শিলাকে ফাটিয়ে দেয় । আবার গাছের পাতা পচে যে রস বের হয় তা শিলার রাসায়নিক আবহবিকার ঘটাতে সাহায্য করে । ঠিক একইভাবে শিলার উপর অবস্থিত মস , লাইকেন , শৈবাল এরা শিলার উপর জল ধরে রাখতে সাহায্য করে । এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্ভিদগুলি পচে হিউমাস তৈরি করে । এই হিউমাসের উপর বৃষ্টির জল পড়লে জৈব অ্যাসিডের সৃষ্টি হয় যা পরবর্তী সময়ে ব্যাসল্ট , ম্যাগনেসিয়াম , ফেল্ডম্পার এবং সালফার যৌগ দ্বারা গঠিত শিলাকে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ত্বরান্বিত করে । উদ্ভিদ ছাড়াও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী যেমন কেঁচো , ইঁদুর , খরগোশ , কুকুর - সহ বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গা শিলার ভেতর গর্ত করে আবহবিকারে সাহায্য করে ।
[6 ] সময় ( Time ) : সময়কে আবহবিকারের অন্যতম নিয়ন্ত্রক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । কারণ কোনো শিলা কত সময় ধরে ভূপৃষ্ঠের উপর উন্মুক্ত অবস্থায় রয়েছে , কিংবা কত সময় ধরে ভূ - অভ্যন্তরে চাপা পড়ে রয়েছে তার ওপর নির্ভর করে আবহবিকারের পরিমাণ । শিলার উন্মুক্ততা যদি দীর্ঘ সময় ধরে সংঘটিত হয় তাহলে আবহবিকারের মাত্রা অধিক হবে । আবার কোনো শিলা যদি কম সময় ধরে ভূপৃষ্ঠে পড়ে থাকে তাহলে সেই শিলায় আবহবিকার ততটা সংঘটিত হবে না । উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে , ক্রান্তীয় অঞ্চলে ভূমিভাগে পাললিক শিলা দীর্ঘদিন প্রকৃতিতে পড়ে থাকার পর লৌহ অক্সাইডের জারণের ফলে কঠিন হয়ে যায় । যাই হোক সব ধরনের শিলার আবহবিকার সমান হয় না ।
[7] শিলার বর্ণ ( Rocks Colour ) : শিলার রং আবহবিকারে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করে । যে সমস্ত শিলার রঙ হালকা প্রকৃতির সেই শিলাগুলি সূর্যরশ্মি গ্রহণ করতে ততটা সক্ষম নয় । তাই উত্তপ্ত হতে সময় লাগে । যেমন চক , মার্বেল , চুনাপাথর প্রভৃতি । আবার যে সমস্ত শিলার রং গাঢ় প্রকৃতির সেই সমস্ত শিলাগুলির তাপ শোষণ করার ক্ষমতা বেশি বলে তাড়াতাড়ি উত্তপ্ত হয়ে যায় , এবং সেই সঙ্গে যান্ত্রিক আবহবিকার সংঘটিত হয় । এই ভাবে বিভিন্ন নিয়ন্ত্রকগুলি পৃথিবীর বিভিন্নস্থানে অবস্থানরত শিলার উপর আবহবিকার ঘটাতে সাহায্য করে ।
(‡) যান্ত্রিক আবহবিকার Mechanical Weathering
• ধারণা ( Concept ) যে আবহবিকারে শিলাস্তরের কেবলমাত্র ভৌত অর্থাৎ বাহ্যিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে , কিন্তু শিলার অভ্যন্তরীণ অণুর গঠনের কোনো পরিবর্তন হয় না তাকে যান্ত্রিক আবহবিকার বলে । অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতির শক্তি ( উত্তাপ , বৃষ্টিপাত , বায়ুপ্রবাহ , নদী , তুষার , হিমবাহ প্রভৃতি ) দ্বারা চাপের হ্রাস - বৃদ্ধির ফলে ভূপৃষ্ঠের উপরের শিলা চূর্ণ - বিচূর্ণ হয়ে ছোটো ছোটো শিলাখণ্ডে পরিণত হয়ে আদি শিলার উপর অবস্থান করে , তখন তাকে যান্ত্রিক আবহবিকার বলে । আবার অন্য ভাবে বলা যায় যে , যান্ত্রিক পস্থিতিতে শিলার যে গাঠনিক ( structural ) এবং প্রথনগত ( textural ) আবহাওয়ার উপাদান দ্বারা ঘটে তাকে যান্ত্রিক আবহবিকার বলে । এই প্রক্রিয়া মূলত উদ্বুমরু ও শীতল জলবায়ু অঞ্চলে পরিলক্ষিত হয় । এক্ষেত্রে শিলার অভ্যন্তরে এবং বাইরে উদ্ভূত শক্তির মধ্যে যে পীড়নের সৃষ্টি হয়ে যে টানের উদ্ভব হয় তাতে শিলা ভেঙে যায়।
• যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রক্রিয়া ( Processes of Mechanical Weathering )
যান্ত্রিক আবহবিকার প্রক্রিয়ায় শিলাখণ্ড চূর্ণ - বিচূর্ণ হয় তখন শিলার শুধুমাত্র আকৃতি ও অবস্থার পরিবর্তন হয় না । বড়ো আকৃতির শিলাখণ্ড ফেটে গিয়ে চূর্ণ - বিচূর্ণ হয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিলাখণ্ডে পরিণত হয় । কিন্তু শিলার মূলধর্ম একই থাকে । যে পীড়ন ও টানের কারণে যান্ত্রিক আবহবিকার হয় , তা অনেকগুলি কারণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত । আবার এই আবহবিকারের ফলে যে সমস্ত ভূমিরূপ গঠিত হয় , সেগুলি কতকগুলি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সংঘটিত হয় যা নিম্নে আলোচনা করা হল--
{১} চাপ বা ভার হ্রাস ( Unloading )
আগ্নেয় পাললিক ও রূপান্তরিত শিলাস্তরগুলি ভূপৃষ্ঠের অনেক নীচে অধিক গভীরতায় অবস্থান করে এবং সেখানে অধিক চাপ লক্ষ করা যায় । পরবর্তী সময়ে ভূমির ক্ষয় ও উত্থানের ফলে নীচের শিলার স্তর থেকে চাপ হ্রাস পেলে শিলা উন্মুক্ত হয়ে প্রসারিত হয় । এর ফলে শিলার মধ্যে দারণ ও ফাটলের সৃষ্টি হয় । এই ফাটলগুলি ভূপৃষ্ঠের সমান্তরালে অধিক প্রসারিত হয়ে বৃহৎ শিলাখণ্ডটি অনেকগুলি পাতের মতো অংশে বিচ্ছিন্ন হয় ।
{২} পাতমোচন ( Sheeting )
অনেকে ভার হ্রাসজনিত শিলার পাতের ন্যায় বিচ্ছিন্ন হওয়াকে পাতমোচন প্রক্রিয়া বলে । কিন্তু এটি একটি যান্ত্রিক আবহবিকারের ভিন্ন প্রক্রিয়া । সাধারণত আঞ্চলিক স্তরে চাপ হ্রাস পেলে বিশাল আকৃতির শিলাগুলি পাতের ( sheet ) আকৃতিতে মূল শিলা শিলাখন্ড থেকে বিচ্যুত হয় । পরবর্তী সময়ে এই পাতের মতো শিলাস্তরগুলি বৃহৎ শিলাখণ্ডে পরিণত হয় , এবং পরে অভিকর্ষের টানে এই শিলার পাতগুলি নীচে ভেঙে পড়ে । পুরুলিয়ার জয়চন্ডী পাহাড়ের নাইস শিলাস্তরে এই ধরনের পাতের গঠন লক্ষ করা যায় ।
{৩} উষ্নতাজনিত প্রসারণ ও আবহবিকার ( Thermal Expansion and Weathering )
যে কোনো শিলা বিভিন্ন ধরনের খনিজের সমন্বয়ে গঠিত । শিলারাশির উপর পতিত সূর্যরশ্মির তাপে শিলার ওপরের স্তর প্রসারিত হয় এবং তাপমাত্রা হ্রাস পেলে সংকুচিত হয়ে থাকে । দীর্ঘদিন এইভাবে চলতে থাকলে শিলার মধ্যে অবস্থিত খনিজগুলির বাঁধন শিথিল হয় এবং শিলা ভেঙে যায় । এই ধরনের সংকোচন ও প্রসারণের প্রভাবে শিলাখন্ডগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয় । আবার ঋতু অনুযায়ী এর তারতম্য লক্ষ করা যায় ।
{৪} তুষার বা লবণ কেলাসন ( Ice or Salt Crystal Growth )
বিভিন্ন লবণ খনিজের কেলাস বৃদ্ধি পেলে চারপাশে প্রসারণ বলের সৃষ্টি করে যান্ত্রিক আবহবিকার ঘটায় । শিলার ফাটলের মধ্যে জল কিংবা লবণ কেলাসিত হলে তার আয়তন বেড়ে গিয়ে শিলার অভ্যন্তরে টানের সৃষ্টি হয় । সুতরাং শিলা যান্ত্রিকভাবে ভেঙে যায় । এই প্রক্রিয়াকে কেলাসন বলে । মেরু জলবায়ু অঞ্চলে শিলাস্তরে তরল জল প্রবেশ করলে , সেই জল অধিক শীতল হয়ে গেলে কেলাসিত রূপ ধারণ করে । আবার এর আয়তন বৃদ্ধি পেলে শিলাস্তরে ফাটলের সৃষ্টি হয় এবং পরে ফাটল প্রসারিত হয়ে শিলায় যান্ত্রিক আবহবিকার ঘটে । এই প্রক্রিয়াকে অনেকে তুহিন আবহবিকার বলে ( frost weathering ) । একইভাবে জলে দ্রবীভূত লবণ শিলার ফাটলের মধ্যে কেলাসিত হয়ে টানের উদ্ভব হলেও শিলা যান্ত্রিকভাবে ভেঙে যায় ।
{৫} জলীয় বাষ্পের প্রভাবে স্ফীতি ( Moisture Swelling )
ভূপৃষ্ঠের উপর উন্মুক্ত শিলারাশি , বায়ুমণ্ডল থেকে জলীয় শোষণ করে ফুলে যায় বা প্রসারিত হয় কিংবা সূর্যরশ্মির তাপের প্রভাবে বায়ুমণ্ডলে সরাসরি জলীয় বাষ্প মোচন করলে এই শিলাখণ্ডের আয়তনের পরিবর্তন ঘটতে থাকে । ফলস্বরূপ শিলায় তাপমাত্রাজনিত যান্ত্রিক আবহবিকার ঘটতে থাকে
{৬} শিথিলকরণ ( Slaking )
যান্ত্রিক আবহবিকারের নিয়ন্ত্রকগুলি ( অর্থাৎ তাপমাত্রা , বৃষ্টিপাত ) ক্রমাগত এবং পর্যায়ক্রমে কোনো শিলার ওপর পতিত হলে , শিলার চরিত্র পরিবর্তিত হয় । অর্থাৎ শিলাখন্ডটি শুদ্ধ ও আর্দ্র হতে হতে শিথিল হয়ে যায়। যার ফলে যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রক্রিয়ার দ্বারা ভেঙে যায় যাকে শিথিলকরণ বলে । এখানে শিলাস্তরে বারবার শুদ্ধ ও আর্দ্র অবস্থার সৃষ্টি হলে শিলাস্তরে পাতলা পাতের মতো শঙ্ক বা খোসার মোচন হয় ।
{৭} অন্যান্য প্রক্রিয়া ( Other Process )
আলোচ্য মুখ্য প্রক্রিয়াগুলি বাদ দিয়ে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে আবহবিকারের জন্য । কিছু গৌণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া রয়েছে । সেগুলি হল
( a ) বুদবুদ ক্ষয় ( cavitation ) যা জলের মধ্যে অবস্থান করে ফেটে গিয়ে শিলায় চাপ সৃষ্টি করে ।
( b ) ঘর্ষণ ( abrasion ) যা একটি শিলা অন্য শিলার উপর পতিত হলে ঘর্ষণের সৃষ্টি হয়ে আবহবিকার ঘটে ।
( c ) যান্ত্রিক ধস ( mechanical collapse ) যা কোনো শিলাস্তরের পাদদেশ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে গেলে উপরের অংশ ধসে পড়ে গেলে আবহবিকার শুরু হয় ।
( d ) কলয়েড উৎপাটন ( colloid plucking ) যা মৃত্তিকার একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপাদান হল ' কলয়েড ' । কলয়েড এক প্রকার জৈব ও খনিজের সমন্বয়ে গঠিত একধরনের আঁঠালো পদার্থ । এই কলয়েড শুকিয়ে গেলে অর্থাৎ মৃত্তিকায় কলয়েড উৎপাদনের মাধ্যমে শিলার উৎপাটন প্রক্রিয়া সংঘটিত হয় । যার ফলে শিলাস্তরের উপরের অংশ খসে পড়ে ।
( e ) আবার বড়ো উল্কাপাতের ফলে যদি শিলারাশির সঙ্গে সংঘর্ষ হয় , যেন শিলা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় । কিংবা পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে শিলায় আবহবিকার ঘটে ।
(‡) যান্ত্রিক আবহবিকারের শ্রেণিবিভাগ Type of Mechanical Weathering বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যান্ত্রিক আবহবিকার সংঘটিত হয় । এই আবহবিকারের প্রধান প্রধান ধরনগুলি নীচে আলোচনা করা হল
[1] প্রস্তর চাঁই বিচ্ছিন্নকরণ ( Block Disintegration ) : যান্ত্রিক আবহবিকারের ধরনগুলির মধ্যে অন্যতম হল প্রত্য চাই বিচ্ছিন্নকরণ । শিলা তাপের কুপরিবাহী । কিন্তু উয় মরু অঞ্চলে দিনে প্রচণ্ড উত্তাপ এবং রাতে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা অনুভূত
হ য় । দিনের বেলায় সূর্যের তাপে শিলার উপরের অংশ যতটা উত্তপ্ত হয়ে প্রসারিত হয় কিন্তু শিলার ভেতরের অংশ ততটা তাপ গ্রহণ করতে পারে না বলে শিলা ততটা প্রসারিত হতে পারে না । আবার দিনের বেলায় উপরের অংশ যতটা প্রসারিত হয় , ঠিক ঐ রাতে ঠাণ্ডায় ততটা সংকোচন হয় । এইভাবে দীর্ঘদিন চলার পরে শিলার উপর ও নীচের মধ্যে একটা পীড়নের সৃষ্টি হয় । এই পীড়নের মান একটা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে শিলার মধ্যে কতকগুলি সমাপ্তরাল ও লম্বভাবে ফাটলের সৃষ্টি হয় । এক সময় বিভিন্ন ফাটলের মধ্যবর্তী শিলারাশি বা মূল শিলা থেকে চূর্ণ - বিচূর্ণ হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে । একেই প্রস্তর চাই বিচ্ছিন্নকরণ বলে । মূল শিলা থেকে ভেঙে যাওয়া শিলাখণ্ডের আকৃতি অনেকটা বর্গক্ষেত্র বা আয়তক্ষেত্রের মতো হয় । একে চৌকাকার বা পিন্ড বিশরণ ( block disintegration ) বলে । আকৃতি বিভিন্ন কোণ বিশিষ্ট হলে তাকে কৌণিক - বিশরণ ( angular disintegration ) বলে । আবার শীতল জলবায়ু অঞ্চলে শিলার ফাটল ও সারণের মধ্যে অবস্থিত জল কেলাসিত হয়ে বরফে পরিণত হয়ে শিলার অভ্যন্তরে চাপের সৃষ্টি হয় । এর ফলে শিলা ফাটলগুলি প্রসারিত হয়ে বহু ক্ষুদ্রাকার ঘনকাকৃতি খণ্ডে বিভক্ত হয় ।
[2] শঙ্কমোচন [ Exfoliation : যান্ত্রিক আবহবিকারে আরেকটি অন্যতম ধরন হল শঙ্কমোচন । এই ধরন উন্নতার তারতম্যের ফলে হয়ে থাকে । শঙ্কমোচন যান্ত্রিক আবহবিকারের তাপীয় প্রসারণের একটি উল্লেখযোগ্য প্রক্রিয়া । যে সমস্ত শিলা একই প্রকৃতির অর্থাৎ খনিজের সংমিশ্রণ একই , সেই শিলাগুলিতে এই ধরনের আবহবিকার সংঘটিত হয় । অর্থাৎ শিলাস্তরের নীচের তুলনায় উপরিভাগে উন্নতার তারতম্য বেশি লক্ষ করা যায় ।
ফলে সংকোচন এবং প্রসারণ অধিক হয় । এই সংকোচন ও প্রসারণজনিত পীড়নের প্রভাবে শিলাস্তরের উপরিভাগ যতখানি প্রসারিত হয় , নিম্নভাগ কিন্তু ততখানি প্রসারিত হয় না । শিলার উপরিভাগ বেশি উত্তপ্ত হয়ে আয়তনে বেড়ে যায় । যার ফলে নীচের শিলাস্তর থেকে পেঁয়াজের খোসার মতো ধীরে ধীরে খুলে যায় বা ছেড়ে বেরিয়ে আসে একে শব্দমোচন বলে । সমসত্ত্ব শিলা গ্রানাইটে শঙ্কমোচন দেখা যায় । এই ভাবে স্তরে স্তরে শিলার বাইরের অংশ খুলে গেলে শিলার বাইরের আকৃতি গোলাকৃতি হয়ে যায় । আবার যে সমস্ত শিলায় দারণগুলি ভূমির সমান্তরালে অবস্থান করে , সেখানে তাপের পরিবর্তনে শঙ্কমোচনলক্ষ করা যায় ।
[3] ক্ষুদ্রকণা বিশরণ ( Granular Disintegration ) : একাধিক খনিজের সমন্বয়ে গঠিত অসমসত্ত্ব শিলায় তাপের তারতম্যে খনিজগুলো বিভিন্ন হারে আয়তনে বাড়ে বা কমে । কারণ বিভিন্ন খনিজের আপেক্ষিক তাপ বিভিন্ন ফলে খনিজগুলি নিজেদের মধ্যে ধাক্কা খেয়ে বাইরে ছিটকে বেরিয়ে আসে এবং শিলা চূর্ণ - বিচূর্ণ হয় । মরু অঞ্চলে সূর্যাস্তের পর এই ভাঙন অনেকটা পিস্তল থেকে গুলি ছোঁড়ার শব্দের মতো হয় । একে ক্ষুদ্রকণা বিশরণ বলে । এই প্রক্রিয়া ম অঞ্চলে সূর্যাস্তের পর ঘটতে দেখা যায় ।
সাধারণত গাঢ় বর্ণের খনিজগুলি হালকা বর্ণের খনিজের তুলনায় দ্রুতহারে এবং অধিক পরিমাণে তাপ শোষণ করার জন্য , অধিকমাত্রায় প্রসারিত হয়ে থাকে । সবশেষে বলা যায় যে , মরু কিংবা মরুপ্রায় খেলে এই পদ্ধতিতে প্রচুর পরিমাণে বালির উৎপত্তি হয় । যেহেতু বিভিন্ন উপাদান দ্বারা এক একটি খনিজ দ্রব্য গঠিত হয় , এবং তারা নিজেদের মধ্যে সংঘবন্ধ অবস্থায় থাকে । কিন্তু শিলায় আবহবিকার ঘটলে সেই সংঘবন্ধতা নষ্ট হয়ে যায় , তখন শিলাখণ্ডগুলো ছোটো ছোটো বালিকণায় পরিণত হয় ।
[4] অন্যান্য ধরন ( Other Types ) : উপরিউক্ত মুখ্য যান্ত্রিক আবহবিকারগুলি বাদ দিয়েও আরো কতকগুলি গৌণ যান্ত্রিক আবহবিকার লক্ষ করা যায় সেগুলি নাচে আলোচনা করা হল।
( a ) বোল্ডার ভাঙন ( Boulder Cleaving ) : কোনো সূক্ষ্ম - প্রথনযুক্ত এবং ঘন সংঘবন্ধ শিলার মধ্যে কঠিন বড়ো আকারে ইউসমূহ আবদ্ধ থাকলে , এই দুটি উপাদানের মধ্যে তাপ গ্রহণের অসমতার জন্য সংকোচন এবং প্রসারণের ফলে পৃষ্ঠের সমান্তরালে ফাটলের সৃষ্টি হয় । ক্রমশ এই ফাটল প্রসারিত হলে নুড়িগুলি কিংবা শিলাগুলি ভূমি দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । এই পদ্ধতিকে বোল্ডার ভাঙন বলে ।
( b ) ময়লার সংস্পর্শে ভাঙন ( Dirt Cleaving ) বিভিন্ন শিলার ফাটলের মধ্যে হলো , বালি ময়লা জমা হলে পরে সেই মালা বা বুলি বালি দীর্ঘদিন জমাট বেঁধে অত্যধিক তাপে সন্বিত পদার্থগুলে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করলে , ফাটল বরাবর শিল ভেঙে যায় । একে ময়লার সংস্পর্শে ভাঙন বলে । এই শিলাচূর্ণগুলি বিভিন্ন আকারের হলে এই প্রক্রিয়া অপেক্ষাকৃত সহজ হয় । অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণ অংশে মরুভূমিতে এই ধরনের আবহবিকার লক্ষ করা যায় ।
(‡) আবহবিকারের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ Landforms Produced by Weathering শিলার আবহবিকারের প্রভাবে বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ভূমিরূপের সৃষ্টি হয় । আবহবিকারের প্রক্রিয়াকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করা হয় । যথা— যান্ত্রিক আবহবিকার এবং রাসায়নিক আবহবিকার । এই দুই প্রক্রিয়া অনুসারেও ভূমিরূপকে দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় । যথা— ( A ) যান্ত্রিক আবহবিকারের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ ( B ) রাসায়নিক আবহবিকারের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ আবার অনেক ক্ষেত্রে এই দুই প্রক্রিয়া এক সঙ্গে মিলিত হয়ে ভূমিরূপ সৃষ্টি হয় , কিন্তু একটি ভূমিরূপ সৃষ্টিতে যেকোনো একটি প্রক্রিয়া সক্রিয়ভাবে ভূমিকা গ্রহণ করে । মূলত আবহবিকার এককভাবে কাজ করে কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে ভূমিরূপ সৃষ্টি করতে পারে না । অনেক ক্ষেত্রে নদীর ক্ষয়কার্য কিংবা অন্যান্য প্রক্রিয়া ভূমিরূপ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে । নীচে আবহবিকারের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপগুলি আলোচনা করা হল—
• যান্ত্রিক আবহবিকারের ফলে সৃষ্ট ভূমিরূপ ( Landforms Produced by Mechanical Weathering ) শুধুমাত্র যান্ত্রিক আবহবিকারের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভূমিরূপ সৃষ্টি হয় । কিন্তু ভূপৃষ্ঠের ওপর অনেক ভূমিরূপ লক্ষ করা যায় , যার সঙ্গে যান্ত্রিক আবহবিকারের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে , নিম্নে সেগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করা হল ।
[1] ভারহ্রাস গম্বুজ ( Unloading Dome ) : ভার হ্রাসের ফলে শিলায় যান্ত্রিক আবহবিকার ঘটলে শিলার মধ্যস্থ প্রস্ত খণ্ডগুলি সংকীর্ণ পাতের আকারে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি ক্ষুদ্রাকার নীচু ও উত্তরা ঢিপির আকারে ভূপৃষ্ঠে অবস্থান করে এই ভূমিরূপটি দেখাতে গম্বুজের মতো হয় বলে একে ভার হ্রাস গম্বুজ বলে । এর উপরিভাগ পেঁয়াজের খোলার ন্যায় কেটে নেওয়া স্তরে স্তরে উচ্চ গোলাকৃতি ভূমিরূপ সৃষ্টি করে । এই গম্বুজের উচ্চতা কয়েকশো ফুট উঁচু । উদ্বেধী শিলা দীর্ঘ দিন ক্ষয়কার্যের ফলে ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে এসে উপরের বোঝার হ্রাসের জন্য উপরের দিকে ধনুকের ন্যায় বেঁকে যায় যা দেখতে অনেকটা গম্বুজাকৃতি হয় । 2
[2] হুড্ডুশিলা ( Hoodoo Rocks ) : বৈষম্যমূলক যান্ত্রিক আবহবিকারের ফলে স্তম্ভের আকারে যে উচ্চভূমির সৃষ্টি হয় তাকে হুড্ডু শিলা বলে । শিলাস্তরে অনেক সময় অসম ভাবে যান্ত্রিক আবহবিকারের ফলে যে বিচিত্র আকৃতির ক্ষুদ্রাকার উন্নস্থ শিলার উদ্ভব ঘটে যা হুড্ডু শিলা নামে পরিচিত । এই শিলাগুলি একত্রে পাশাপাশি ভাবে খিলানের ন্যায় অবস্থান করে ।
[3] ট্যালাস ( Scree ) : সূর্যরশ্মির তাপের প্রভাবে উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে তুষার কাজের ফলে শিলার ফাটল প্রসারিত হয়ে তীক্ষ্ণ বা কোণ বিশিষ্ট বিভিন্ন প্রস্তর খণ্ড সৃষ্টি করে এই প্রস্তর খন্ডগুলি পর্বতের পাদদেশে কিংবা ঢালের পাদদেশে জমা হলে তাকে স্ত্রী বা ট্যালাস বলে । ভারতের লাদাখ মালভূমিতে এই ধরনের প্রস্তরখণ্ড লক্ষ করা যায় ।
[4] চাপ হ্ৰাসজনিত আস্তরণ ( Unloading Sheet ) : ভূপৃষ্ঠের উপরে শিলার অপসারণজাতি চাপ হ্রাসের কারণে নীচের শিলার উপরের স্তরটি প্রসারণের জন্য খুলে যায় । এই স্তরটি আয়তনে বেশি বড়ো হয় এবং পুরুত্ব বেশি । ভূমিভাগের সমান্তরালে বিস্তীর্ণ ফাটলের স্তরটিকে আলাদা করে দেয় । আবার ' V ' আকৃতির নদী উপত্যকার উভয় পার্শ্বে ঢালু অংশে এই ধরনের প্রসারণজনিত আস্তরণ খুলে আসে । কলোরাডো মালভূমিতে বেলেপাথর যুক্ত অঞ্চলে ' V ' আকৃতির উপত্যকায় এই ধরনের ভূমিরূপ লক্ষ করা যায় ।
[5] কেন্সপ্রাঙ্ ( Ken - Sprang ) : যে সমস্ত ফাটলের দ্বারা বৃহদায়তন বোল্ডারের কম সংখ্যার বড়ো বড়ো খণ্ডে বিভত্ব হয় , তাদের কেন্সপ্রাঙ্ বলে সাধারণত সূর্যরশ্মির তাপীয় কারণে এগুলি সৃষ্টি হয়েছে । প্রাথমিকভাবে মনে করা হলেও ভূ - বিজ্ঞানী ওশিয়ারের মতে , গ্রানাইট শিলার মধ্যবর্তী ছোটো ছোটো ফাটলের স্বতঃস্ফূর্ত প্রসারণের ফলে এই ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে , এই ধরনের ফাটলগুলি চাপ হ্রাসজনিত প্রসারণের ফাটলের মতো সম প্রকৃতির ।
[6] টর ( Tor ) : বিষম আবহবিকারের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিরূপ হল টর । ফাটলযুক্ত শিলাস্তরের মধ্যে ভৌমজল ওঠা নামা করলে ডলেরাইট ও গ্রানাইট শিলা ক্রমশ ক্ষয়ে গিয়ে উপরের শিলাস্তরে অপসৃত হয়ে যায় । এবং নীচে খণ্ড খণ্ড শিলাস্তরে গঠিত ভূমিরূপ উন্মুক্ত হতে থাকে , গণ্ড শিলা সমন্বিত এই ভূমিরূপ টর নামে পরিচিত । এগুলির উচ্চতা 5 থেকে 20 মিটার । গ্রানাইট গঠিত ভূমিরূপ যা দীর্ঘদিন পুঞ্জিত থাকার ফলে পরবর্তী সময় গভীর আবহবিকারের ফলে টর ভূমিরূপ গড়ে উঠেছে । সাধারণত চারপাশের মৃদু ঢাল এলাকার উপর হঠাৎ খাড়াভাবে উঁচু প্রস্তরময় ভূমিভাগটি অবস্থান করছে ।
[7] ইনসেলবার্জ ( Inselberges ) : শুষ্ক বা প্রায় শুষ্ক জলবায়ু অঞ্চলে কিংবা মরু অঞ্চলে যান্ত্রিক আবহবিকারের ফলে গোলাকার বা সমতল শীর্ষ বিচ্ছিন্ন অবশিষ্ট পর্বতগুলি তাদের সংলগ্ন সমভূমি থেকে খাড়া ভাবে উঁচু হয়ে থাকে তাকে ইনসেলবার্জ বলে । মূলত আবহবিকারের ক্ষয়কার্যের ফলে এরূপ ভূমির সৃষ্টি হয় । এই উত্তলাকার বিচ্ছিন্ন টিলা বা গম্বুজাকৃতি ঢিবির ন্যায় ভূমি যখন সংশ্লিষ্ট সমভূমি থেকে সংকীর্ণ উচ্চতায় অবস্থান করে তখন এই ইনসেলবার্ডের উচ্চতা কখনও কখনও 500 ফুট - এর অধিক হয় ।
[8] ফেলসেন মীয়ার ( Felsen meer ) : শীতল ও সুউচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে অধিক উচ্চতায় অবস্থিত শিলাখণ্ডে আবৃত ভূমিকে ফেলসেন মীয়ার বলা হয় । মূলত তুহিন কার্যের ফলে আবহবিকারের মাধ্যমে এই ধরনের ভূমিরূপের উদ্ভব হয় । E. J. Wealand 1934 সালে চাঁচন তল শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন । আর্দ্র ক্রান্তীয় অঞ্চলে কিংবা গ্রানাইট শিলা দ্বারা গঠিত অঞ্চলে যে বিভিন্ন শিলাস্তূপের উপর দীর্ঘদিন গভীর আবহবিকারের ফলে যে রেগোলিথের সৃষ্টি হয় , সেই পদার্থ বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির ক্ষয়ীভবনের মাধ্যমে আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ অপসারিত হওয়ার ফলে যে সমতলভূমির সৃষ্টি হয় তাকে চাঁচন তল বলে । ভূবিজ্ঞানী Wealand- র মতে ঋতুভিত্তিক জলবায়ু - পার্থক্যের জন্য ভৌম জলস্তর ওঠানামা করে এবং যে সমস্ত শিলা রাসায়ানিক আবহবিকারে অংশগ্রহণ করে সেগুলি বাদ দিয়ে বাকি শিলায় এই আবহবিকারের গভীরতা 10 মিটারের বেশি প্রাপ্ত হয় । এবং পরবর্তী সময়ে ওই অঞ্চলে ভূ - অভ্যন্তরীণ শক্তির ক্রিয়ায় ভূমিভাগ উত্থিত হলে আবহবিকারজাত পদার্থ অপসারিত হয় । পরবর্তীকালে সুস্থিত ভূমির ওপর যদি নতুন করে গভীর আবহবিকার সম্পন্ন হয় , তাহলে একইভাবে আবহবিকারজাত পদার্থের সৃষ্টি হবে এবং পুনরায় তা অপসারিত হবে । সুতরাং এই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি লক্ষ করা যায় এবং এখানে শিলা উন্মোচনের ফলে ভিত্তি শিলা ( Bed Rock ) সমান্তরালে অবস্থান করে ।
[9] কোরস্টোন ( Corestone ) : ভূবিজ্ঞানী লিন্টন ( L. D. Linton , 1955 ) -এর মতে , কোরস্টোন এবং টর দুটি পর্যায়ে গঠিত হয় । মূলত কোনো অঞ্চলে প্রথম পর্যায়ে কোরস্টোন গঠিত হওয়ার পরে পরবর্তী পর্যায়ে টর গঠিত হয় । মূলত খণ্ড শিলাগুলি অধিক তাপমাত্রায় যান্ত্রিক আবহবিকারের দ্বারা মূল শিলা থেকে যখন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় অবস্থান করে তখন তাকে কোরস্টোন বলে । আফ্রিকা , দঃ পূর্ব এশিয়া , ব্রাজিল এবং মেক্সিকোতে এই ধরনের কেন্দ্রক শিলা বহু লক্ষ করা যায় ।
[10] মৃত্তিকা স্তম্ভ ( Earth Pillar ) : যান্ত্রিক আবহবিকারের ফলে কোনো শিথিল ও কোমল শিলাস্তর অথবা মৃত্তিকা স্তরের উপরে বড়ো ধরনের নুড়ি বা শিলাখণ্ড অবস্থান করলে ওই শিলাগুলি তার পার্শ্ববর্তী অবস্থানরত শিলা বা মৃত্তিকাকে প্রাকৃতিক শক্তি তথা বৃষ্টিপাত ও বায়ুপ্রবাহের হাত থেকে রক্ষা করে । প্রধান শিলাখণ্ডের পার্শ্ববর্তী সংরক্ষিত শিলাকে মৃত্তিকাগুলি একটি ক্ষুদ্রস্তম্ভের আকারে অবস্থান করলে তাকে মৃত্তিকা স্তম্ভ বলে ।