welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

গ্রানাইট ব্যাসল্ট ও চুনাপাথর শিলাঞ্চলে ভূমিরূপ Landforms on Granite Basalt and Limestone Rock

ধারণা (Concept) পৃথিবী জুড়ে বিরাজমান বিভিন্ন প্রাকৃতিক ক্ষয়কারী ও সঞ্চয়কারী শক্তিসমূহের দ্বারা বা, আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদানের দ্বারা বিস্তীর্ণ শিলা

 গ্রানাইট ব্যাসল্ট ও চুনাপাথর শিলাঞ্চলে ভূমিরূপ Landforms on Granite Basalt and Limestone Rock 

★ভূমিরূপ সৃষ্টির উপর শিলার প্রভাব Influence of Lithology on Landforms 

● ধারণা (Concept) পৃথিবী জুড়ে বিরাজমান বিভিন্ন প্রাকৃতিক ক্ষয়কারী ও সঞ্চয়কারী শক্তিসমূহের দ্বারা বা, আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদানের দ্বারা বিস্তীর্ণ শিলাময় অংশের উপর ক্ষয় বা সময়ের মধ্যে দিয়ে ভূভাগের যে চেহারা বা আকৃতি বা রূপ প্রকাশিত হয়। তাকেই ভূমিরূপ (landforms) বলে। ভূমিব্রপের ক্রমউত্থান বা অবনমানের জন্য যে সমস্ত নিয়ন্ত্রকগুলির কার্যকারিতা বা কার্যকরী গুণ দায়ী সেই সমস্ত নিয়ন্ত্রকগুলির মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও বৈচিত্র্যপূর্ণ নিয়ন্ত্রক হল শিলার গঠন। শিলাসহ শিলার গঠন ও ভূমিরূপের নিবিড় সম্পর্ক ভূমিরূপবিদ্যার এক প্রধান আলোচ্য বিষয়। পৃথিবীর সামগ্রিক ভূভাগ মূলত তিন প্রকার শিলার সমন্বয়ে গঠিত। যথা- 
(a) আগ্নেয়শিলা (igneous rocks), (b) পাললিক বা স্তরীভূত শিলা (sedimentary rocks) এবং (c) রূপান্তরিত শিলা (metamorphic rock)। পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অংশে বিরাজমান উক্ত শিলাসমূহ ও তাদের গঠনের সহিত ঐ অংশের ভূমিরূপসমূহের এক নিদারুণ সম্পর্ক বর্তমান। পৃথিবীর কিছু কিছু বিশেষ অঞ্চল (যেমন–আগ্নেয় শিলাময় অঞ্চল, চুনাপাথর গঠিত অঞ্চল)-এর ভূমিরূপের স্বাতন্ত্র্য ঐ অঞ্চলের শিলার বিশিষ্টতা প্রদান করে। ভূমিরূপবিদ্যায় শিলার গঠন ও ভূমিরূপ সৃষ্টির মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণে দুই ধরনের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা যায়। নিম্নে এই দৃষ্টিভঙ্গি দুটি আলোচনা করা হল 

(1) ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি (Historical Approach): পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের শিলার গঠন ও ভূমিরূপের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনার প্রসঙ্গে অন্যতম দৃষ্টিভঙ্গি হল ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি। যে প্রকার দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে করা হয় যে সমগ্র ভূমিরূপের সৃষ্টি হয় ভূ-গাঠনিক পরিবর্তন, সমুদ্রতলের পরিবর্তন বা, জলবায়ুর পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এবং সামগ্রিক ভূমিরূপের-ই বিবর্তন হয় আলোচা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে, সেই প্রকার দৃষ্টিভঙ্গিকে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি বলা হয়। ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির ধারণাটি মূলত পদ্ধতিগত ভূমিরূপবিদ্যা (process geomorphology) ধারাটির সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। ভূমিরূপবিদ্যার আদিগুরু উইলিয়াম মরিস ডেভিসের মতে, "ভূমিরূপ হল শিলাগঠন, ভূভাগ পরিবর্তন বা বিবর্তনকারী শক্তি ও ক্ষয়ের পর্যায় বা সময়ের সামগ্রিক ফলাফল" (landform is a function of structure, process and stage)। এই প্রকার দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যাপক অর্থে, শিলার গঠন বলতে শিলার সমন্বয় এবং শিলার গুণাবলিকে বর্ণনা করা হয়েছে।

( 2 ) ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ামূলক দৃষ্টিভঙ্গি (Functional Approach) : পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের শিলাসমূহের গঠন ও ভূমিরূপের মধ্যে সম্পর্ক বিশ্লেষণে থাকা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি হল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ামূলক দৃষ্টিভঙ্গি। যে প্রকার দৃষ্টিভঙ্গিতে মনে করা হয় যে সমগ্র ভূমিরূপের সৃষ্টি হয় ভূভাগ ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে সেই প্রকার দৃষ্টিভঙ্গিকে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বলা হয়। এই প্রকার দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম প্রবন্ধা ছিলেন জে. টি. হ্যাক (J. T. Hack)। জে. টি. হ্যাকের মতে, পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের বা অন্যালের ভূমিরূপের পার্থক্য মূলত ঐ সমস্ত অংশ বা অঞ্চলের শিলার কাঠিন্যতার তারতম্যের জন্য ঘটে থাকে। ভূমিরূপবিদ্যার মৌলিক ধারণার আলোচনা করতে গিয়ে W. M. Thornbury বলেছিলেন যে, "ভূমিরূপের বিবর্তনে ভূতাত্ত্বিক গঠনের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে এবং এই প্রকার গঠন ভূপৃষ্ঠের উপরের গঠনের উপর প্রতিফলিত হয়" ("Geologic structure is a dominant controlling factor in the evolution of landforms and is reflected in them.") 

● ভূমিরূপ সৃষ্টির নিয়ন্ত্রকসমূহ (Controlling Factors of Landforms)। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের বা অঞ্চলের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে সৃষ্টি হওয়া ভূমিরূপের উপর কোনো কিছু নিয়ন্ত্রকের নিয়ন্ত্রণ থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন ক্ষেত্রের শিলার বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে শিলার চরিত্র সাধারণত জটিল ধরনের। আবার পরীক্ষার লক্ষ করা গেছে যে পৃথিবীর কোনো একটি ক্ষুদ্র অঞ্চলের গঠনেও নানা প্রকার শিলার সহাবস্থান। পৃথিবীর কোনো বিশেষ শিলায় গঠিত অঞ্চলের ভূমিরূপের গঠন ঐ অঞ্চলের গাঠনিক শিলার বৈশিষ্ট্য ও পার্শ্ববর্তী শিলার দ্বারাও প্রভাবিত হয়। পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিরাজমান শিলার বেশ কিছু ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য ঐ অঞ্চলের শিলার উপর গঠিত ভূমিরূপের নিয়ন্ত্রক হিসাবে কার্য সম্পাদন করে থাকে। নিম্নে এই নিয়ন্ত্রকগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল— 

(1) শিলার গ্রথন (Texture of Rock): পৃথিবীর ভূমিরূপ সৃষ্টির অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসাবে বিবেচিত বিষয় হল শিলার এখন। সাধারণত শিলামধ্যসর ঘনিজ পদার্থসমূহের বিন্যাসের উপর শিলার প্রথন নির্ভরশীল। শিলার প্রথন মূলত দুই প্রকারের হয়। যথা (a) সূক্ষ্ম এথন ও (b) সথূল এখন। সূক্ষ্মগ্রখন বিশিষ্ট শিলার কেলাস বা, ক্রিস্টালগুলি অতি ঘন সন্নিবিষ্ট থাকার দরুন এই শিলা আবহবিকারে বাধা প্রদর্শন করে। এর ফলাফলে শিলার ক্ষয় কম হয়ে স্বল্প ক্রয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। আবার, মূল এখন বিশিষ্ট শিলার কেলাসগুলি অঘন সন্নিবিষ্ট বা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকার দরুন এই শিলা আবহবিকারে বাধা প্রদর্শন করলেও এই শিলার ক্ষয় বেশি হয়ে বৃহৎ মাত্রায় ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। 

(2) শিলার কাঠিন্যতা (Hardness of Rock): পৃথিবীর ভূমিৰূপ সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক হিসাবে বিবেচিত দ্বিতীয় বিষয় হল শিলার কাঠিন্যতা। শিলার কাঠিন্যতা বা, যান্ত্রিক প্রতিরোধ ক্ষমতা ভূমিরূপকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করতে পারে না। কারণ, শিলার অন্যান্য কিছু বৈশিষ্ট্য শিল্পার কাঠিন্যতার প্রভাবকে হ্রাস করে। সাধারণত যে সমস্ত শিলার কঠিন্যতা (hardness) অনেক বেশি, সেই সমস্ত শিলা যথেষ্টভাবে ক্ষয় প্রতিরোধ করে কম মাত্রার কয়লাভ ভূমিরূপ বা প্রায় উচ্চভূমি সৃষ্টি করে। যেমন—গ্রানাইট, নিস্ ও কোয়ার্টভাইট জাতীয় শিলার কাঠিন্যতা যথেষ্ট বেশি হওয়ার দরুন এই সমস্ত শিলা ক্ষয় প্রতিরোধ করে বিভিন্ন প্রকার উচ্চভূমি, টিলা, ইনসেলবার্জ, বোনহার্ড বা শৈলশিরা তৈরি করে। আবার, চুনাপাথর, ডলোমাইট, কাদাপাথর ও খড়ি পাথর শিলার কাঠিন্যতা যথেষ্ট কম হওয়ার দরুন এই সমস্ত শিলা ক্ষয় প্রতিরোধে অক্ষম হয়। এই সমস্ত শিলার উপর সাধারণত নিম্ন উপতাকা, গর্ত প্রভৃতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপালেশিয়ান পার্বত্য অঞ্চলে শেনান্‌দোহা নদী অববাহিকায় কঠিনতর বেলেপাথর ও কোয়ার্টজাইট শিলা কম ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে উচ্চভূমি ও খাড়া ঢাল সৃষ্টি করেছে এবং এর সংলগ্ন কোমলতর চুনাপাথর অধিক ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে নীচু ও তরঙ্গায়িত সমভূমির সৃষ্টি করেছে। 

(3) শিলার দারণ (Joints of Rock): পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অংশের ভূমিরূপের নিয়ন্ত্রকসমূহের মধ্যে অন্যতম হল শিলার মারণ। শিলার মধ্যস্থ এই দারণসমূহগুলি যান্ত্রিক ও রাসায়নিক আবহবিকারের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শিলাসমূহের ক্ষয়সাধনে সহায়তা করে। যে সমস্ত শিলায় দারণ বা জয়েন্টসের পরিমাণ বেশি সেই সমস্ত শিলায় প্রবেশ্যতার পরিমাণ বেশি হয়ে যুত শিলার ক্ষয় পরিসাধিত হয়ে বেশি ক্ষয়প্রাপ্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। আবার, যে সমস্ত শিলায় সারণের পরিমাণ কম সেই সমস্ত শিলায় প্রবেশ্যতার পরিমাণ কম হয়ে অদ্ভুত শিলার ক্ষয় পরিসাধিত হয়ে কম ক্ষ্যাপ্রাপ্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। ইহলে জলনির্গম প্রণালীর ধরন শিলায় দারণের বিন্যাসের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। দারণ ব্যবস্থায় জ্যামিতিক বিন্যাস অনুসারে সমান্তরাল, কৌণিক, আয়তক্ষেত্রাকার প্রভৃতি নানা ধরনের জলনির্গম প্রণালীর সৃষ্টি হয়ে থাকে।

(4) শিলার স্তরায়ণ তলের উপস্থিতি (Presence of Bedding Plane) : পৃথিবীর ভূমিরূপ সৃষ্টির নিয়ামক হিসাবে বিবেচিত চতুর্থ বিষয় হল শিক্ষার স্তরায়ণ তলের উপস্থিতি। যে সমস্ত শিলার স্তরায়ণ তলের পরিমাণ বেশি এবং স্তরায়ণতল ভূপৃষ্ঠের উপর উন্মুক্ত অবস্থায় বিরাজ করে, সেই সমস্ত শিলায় এই স্তরায়ণতল বরাবর ক্রয়কার্য যথেষ্ট বেশি হয় ও শিলা প্রান্ত হয়ে অধিক ওয়জাত ভূমিরূপের সৃষ্টি করে। আবার যে সমস্ত শিলায় স্তরায়ণ তালের সংখ্যা কম এবং স্তরায়ণ তল ভূপৃষ্ঠের যথেষ্ট নিম্নে অবস্থিত, সেই সমস্ত শিলায় স্তরায়ণ তল বরাবর ক্ষয়কার্য যথেষ্ট কম হ্যা ও শিলা কম ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে স্বল্প ক্ষয়জাত ভূমিরূপের জন্ম দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আগ্নেয় শিলা ও রূপান্তরিত শিলার তুলনায় পাললিক শিলায় স্তরায়ণ তল যথেষ্ট বেশি বলে এবং পাললিক শিলার স্তরায়ণ তল ভূপৃষ্ঠের উপরে উন্মুক্তভাবে অবস্থান করায়, পাললিক শিলার স্তরায়ণ তল বরাবর ক্ষয় যথেষ্ট বেশি হয়ে অধিক ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়। 

(5) শিলার সচ্ছিদ্রতা (Porosity of Rock) : পৃথিবীর ভূমিরূপসমূহের সৃষ্টির নিয়ন্ত্রকরূপে বর্ণিত পঞ্চম নিয়ন্ত্রক হল শিলার সচ্ছিদ্রতা। শিলার মধ্যেকার সচ্ছিদ্রতা বলতে সাধারণত শিল্পামধ্যস্থ খনিজগুলির মাঝখানের ক্ষুদ্র বা সূক্ষ্ম কীর গুলিকে বোঝানো হয়। শিলার সচ্ছিদ্রতা সাধারণত খনিজ কণার আকুতি, গঠন ও সংঘবন্ধতার উপর নির্ভর করে। শিলার মধ্যেকার সচ্ছিন্নতার পরিমাণ অসম আয়তনের খনিজসমূহের ক্ষেত্রে যথেষ্ট কম ও সম আয়তনের খনিজসমূহের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বেশি হয়ে থাকে। যে সমস্ত শিলার সচ্ছিদ্রতার পরিমাণ যত বেশি হবে সেই সমস্ত শিলা ততই কম ক্ষয় প্রতিরোধ করে অধিক ফ্যাবিশিষ্ট ভূমিরূপের জন্ম দেবে। আবার, যে সমস্ত শিলার সচ্ছিদ্রতার পরিমাণ যথেষ্ট কম, সেই সমস্ত শিলা বেশি ক্ষয় প্রতিরোধ করে কম ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের জন্ম দেবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বেলেপাথর বা চুনাপাথর শিলার সচ্ছিদ্রতা গ্রানাইট বা শ্লেট জাতীয় শিলার সচ্ছিদ্রতা থেকে যথেষ্ট বেশি হওয়ার দরুন বেলেপাথর বা চুনাপাথর শিলাগঠিত অঞ্চলে অধিক ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি হয় এবং গ্রানাইট ও শ্লেট শিলাগঠিত অঞ্চলে স্বল্পক্ষয় বিশিষ্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। শিলার সচ্ছিদ্রতা প্রাথমিকভাবে শিলাগাত্রে অধিক ক্ষয় সংঘটিত করতে সাহায্য করলেও পরবর্তী সময়ে শিলাগাত্রে ক্ষয়ের পরিমাণের হ্রাস ঘটিয়ে থাকে। 

(6) শিলার প্রবেশ্যতা (Permeability of Rock) : পৃথিবীর ভূমিরূপ সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক হিসাবে বিবেচিত ষষ্ঠ বিষয় হল-শিলার প্রবেশ্যতা। শিলার প্রবেশ্যতা বলতে সাধারণত শিলার ভিতর দিয়ে জল প্রবাহিত হওয়ার ক্ষমতাকে বোঝায়। শিলার প্রবেশ্যতা সাধারণত শিলার ফাটল, শিলার সংযুক্তি ও শিলার স্তরায়ণ তলে অবস্থিত দারণের উপর নির্ভরশীল। যে সমস্ত শিলার প্রবেশাতা যথেষ্ট বেশি, সেই সমস্ত শিলার মধ্যে দিয়ে জলের দ্রুত প্রবাহের দরুন শিলার মধ্যে ক্ষয়ের পরিমাণ অতি অল্প হারে ঘটে কম ক্ষয়প্রাপ্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। কিন্তু যে সমস্ত শিলার প্রবেশ্যতা যথেষ্ট কম, সেই সমস্ত শিলার মধ্যে দিয়ে জলের অদ্ভুত প্রবাহের দরুন শিলার মধ্যে ক্ষয়ের পরিমাণ যথেষ্ট বেশি হারে সংঘটিত হয়ে অধিক ক্ষয়প্রাপ্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যুক্তরাজ্যের কার্বনিফেরাস যুগের চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলে প্রবেশ্যতা যথেষ্ট বেশি থাকার দরুন, সেই অংশে কম ক্ষয়কার্য সংঘটিত হয়ে উচ্চ মালভূমি, খাড়া ঢাল ও শৈলশিরা গঠিত হয়েছে। 

(7) শিলার দ্রাব্যতা (Solubility of Rock) শিলার প্রাঝতা ভূমিরূপ সৃষ্টির একটি অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রক। শিলার দ্রাব্যতা কথাটি শিলার দ্রবণ ক্রিয়ার সহিত নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। যে সমস্ত শিলা যত প্ৰাব্য অর্থাৎ দ্রাবকের সংস্পর্শে এসে নিজের আকার হারিয়ে ফেলে বা দ্রাবকে মিশে যায়, সেই সমস্ত শিলার মধ্যে ততই ক্ষয়কার্য সংঘটিত হয়ে ক্ষয়কার্যের উত্তম ভূমিরূপসমূহ গড়ে ওঠে। আবার অন্যদিকে, যে সমস্ত শিলা যত কম ব্রাব্য সেই সমস্ত শিল্প তত বেশি ক্ষয় প্রতিরোধ করে স্বল্প ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গ্রানাইট শিলার প্রাব্যতা কম হওয়ায় এই শিলাপৃষ্ঠে যে সংখ্যক স্বল্প ক্ষয়জাত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়; চুনাপাঘর বা ডলোমাইট শিলার প্রাব্যতা যথেষ্ট বেশি হওয়ায় এই শিলাপৃষ্ঠে তার থেকে বেশি সংখ্যক অধিক ক্ষয়বিশিষ্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়।

(৪) শিলার খনিজ ও রাসায়নিক সংযুক্তি (Minerological and Chemical Composition of Rocks) : শিলার খনিজ ও রাসায়নিক সংযুক্তি যথেষ্ট রূপে পৃথিবীপৃষ্ঠে ভূমিরূপ সৃষ্টির নিয়ন্ত্রক রূপে কাজ করে থাকে। এক প্রকার বিশেষ ধরনের শিলার মধ্যন্য খনিজ সমন্বয়ন ও শিলার মধ্যস্থ রাসায়নিক সংযুক্তির দ্বারা শিলা দ্রুত হারে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে অধিক ক্যাবিশিষ্ট ভূমিরূপের জন্ম দেয়। এই প্রকার শিলার একটি আদর্শ উদাহরণ হল চুনাপাথর। চুনাপাথর শিলাগঠিত অংশে নিবিড়ভাবে রাসায়নিক আবহবিকারের দরুন আদর্শ কার্স্ট ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। কোনো স্থানে দীর্ঘকাল ধরে রাসায়নিক আবহবিকারের ফলে নানা ধরনের কাদার সৃষ্টি হয়। এই ধরনের কাদা সঞ্চিত হতে হতে কাদাস্তর সৃষ্টি করে থাকে। আবার অন্য এক প্রকার শিলামধ্যস্থ খনিজ সমন্বয়ন ও রাসায়নিক সংযুক্তির দ্বারা শিলা অদ্ভুত হারে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে স্বল্প ক্ষ্যাবিশিষ্ট ভূমিরূপের জন্ম দেয়।

★ গ্রানাইট শিলার গঠিত ভূমিরূপ Landforms on Granite 
গ্রানাইট হল সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য পাতালিক আগ্নেয় শিলা। ভূত্বকের অধিক গভীরতায় আম্লিক ম্যাগমা অত্যন্ত ধীরে ধীরে শীতল ও কঠিন হয়ে গ্রানাইটের জন্ম দেয়। গ্রানাইটের প্রধান বৈশিষ্ট্য হল মধ্যম থেকে বৃহৎ ও সমান আকার বিশিষ্ট পরস্পর সংযুক্ত ও সম্পূর্ণ কেলাসিত দানার সমন্বয়ে সৃষ্ট বুনন, কঠিন ও পিণ্ডাকার গঠন ও অধিক দারণ বিশিষ্ট। এই প্রকার শিলাসমূহের কণাগুলির আবার প্রায় সমান আকৃতির হয়ে বলে, গ্রানাইট শিলাকে 'সমআকৃতির কণাবিশিষ্ট শিলা ও বলা হয়। আগ্নেয় শিলাসমূহের মধ্যে গ্রানাইট হল বালুকাযৌগ শ্রেণির প্রধান শিলা। এই শিক্ষা সাধারণত কোয়ার্টজ, বালুকা, ফেল্ডম্পার, অভ্র, টুর্মালিন, অনেক ক্ষেত্রে সোডিয়াম ও পটাশ দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। ভূত্বকে গ্রানাইট শিলার উপস্থিতি সাধারণত উন্মুক্ত ঝাথোলিথ বা অন্যান্য উদবেধী গঠনে লক্ষ করা যায়। অধ্যাপক Young Tuidel-এর মতে গ্রানাইট শিলায় গঠিত ভূমিরূপের ঢাল যথেষ্ট খাড়াই প্রকৃতির হয় এবং গ্রানাইট শিলার মধ্যে জলের প্রবেশ্যতা কম হয় বলে এই প্রকার ভূমিরূপে দসও যথেষ্ট কম হয়ে থাকে। কিন্তু গ্রানাইট শিলায় যদি পারণের যথেষ্ট উপস্থিতি থাকে তাহলে এই শিলায় ধসের জন্ম হতে পারে। আর্দ্র জলবায়ু অংশে গ্রানাইট সাধারণত আবহবিকারজাত ভাশেষে আবৃত অবতল অথবা, সমভূমির মাধ্যমে পরস্পর থেকে পৃথক বহু সুস্পষ্ট স্তূপাকার ও গম্বুজাকৃতির পাহাড় সৃষ্টি করে। এইরুপ ভূচিত্রে প্রায়শই দারণ নিয়ন্ত্রিত মধ্যম বুননের বৃক্ষরূপী থেকে কৌণিক নদী বিন্যাস লক্ষ করা যায়। অপরদিকে, শুষ্ক জলবায়ু অঞ্চলে গ্রানাইটের স্তুপগুলি অধিক ব্যবচ্ছিন্ন হয়ে বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিরূপ গঠন করে থাকে। জলপ্রবাহ ও আবহবিকারের দ্বারা গ্রানাইট শিলার উপরে তাদের একক কিংবা যুগপৎ ক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যে সমস্ত ভূমিরূপগুলি সৃষ্টি হয় তা নিম্নে আলোচনা করা হল— 

(1) গোলাকৃতি ভূমিরূপ (Rounded Landscape): গ্রানাইট শিলার উপর জলপ্রবাহ কিংবা, আবহবিকারের দ্বারা সৃষ্ট যে সমস্ত ভূমিরূপটি গুরুত্বপূর্ণ, তাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান ভূমিরূপ হল গোলাকৃতি ভূমিরূপ। গ্রানাইট শিলা ভূগর্ভের পাতালিক অংশে গঠিত হলেও দীর্ঘ সময়ব্যাপী ভূভাগের উপর আবহবিকার ও নগ্নীভবনের ফলে বা ভূ-আলোড়ন জনিত কারণে গ্রানাইট শিলা ভূপৃষ্ঠে প্রকাশিত হয়। এই উন্মোচিত গ্রানাইট শিলার উপর মূলত যান্ত্রিক আবহবিকারের শঙ্কমোচন (exfoliation) পক্রিয়ার ক্রম প্রভাবকরণের মধ্যে দিয়ে বৃত্তাকার দারণ বা ফাটলের সৃষ্টির ফলে গ্রানাইট শিলার অংশবিশেষ গোলাকারে খলিত হয়ে যে প্রায় গোলাকার ভূমিরূপের জন্ম দেয়, তাকেই গোলাকৃতি ভূমিরূপ বলা হয়। এই প্রকার ভূমিরূপটি দেখতে অনেকটা পাহাড়ের ন্যায় বলে, এই ভূমিরূপটিকে গোলাকৃতি পাহাড় (rounded hillocks) বলা হয়। এই প্রকার ভূমিরূপকে অনেকেই গণ্ডশিলা (boulders) বলেও অভিহিত করেছেন। ভারতের ছোটোনাগপুর মালভূমি অঞ্চলে, সিমলিপাল উচ্চভূমিতে ও দক্ষিণ ভারতের গ্রানাইট শিলাগঠিত আর্কট ও গুন্টুর জেলায় গোলাকৃতি ভুমিরূপের দারুণ নিদর্শন মেলে।



(2) উচ্চভূমি ও শৈলশিরা (Uplands and Ridges): গ্রানাইট শিলার উপর আবহবিকারের প্রভাবে সৃষ্টি হওয়া দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিরূপ হল—উচ্চভূমি ও শৈলশিরা। গ্রানাইট শিলা ভূপৃষ্ঠের বহু নীচে পাললিক শিলাস্তর দ্বারা উধ্বদিকে ও পার্শ্বদিকে আবৃত হয়ে পাতালিক শিলারূপে অবস্থান করে। এই প্রকার অংশের উপরে অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠে আবহবিকারের ক্রম কার্যকারিতার মধ্যে দিয়ে ভূপৃষ্ঠের শিলাস্তর স্বলিত তথ্য ক্ষয়ীভূত হয়। ক্রমাগত আবহবিকার চলতে থাকলে ওই উপ অংশের সামগ্রিক অংশ ক্রমশ ক্ষয়ীভূত হতে হতে আবহবিকারগ্রপ্ত পদার্থরূপে পরিণত হয়। এর পরে এই সমস্ত আবহবিকারগ্রস্ত পার্থসমূহ অপসারিত হয়ে যায়। এই আবহবিকার ও অপসারণ ক্রমাগত চলতে থাকলে ভূ-অভ্যন্তরের গ্রানাইট শিলাযুক্ত অংশ ভূপৃষ্ঠে প্রকাশিত হয় ও তা আবহবিকারের দ্বারা ক্রমশ ক্ষরীভূত হয়ে যে উচ্চ অংশের ন্যায়। ভূমিরূপ সৃষ্টি করে, তাকেই উচ্চভূমি বলা হয়। উচ্চভূমির উচ্চতা গোলাকৃতির ভূমিরূপের উচ্চতা থেকে তুলনামূলকভাবে যথেষ্ট বেশি। এইরূপ কতকগুলি উচ্চভূমি একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে শৃঙ্খলাকারে অবস্থান করলে, তখন সেই ভূমিরূপকে শৈলশিরা বলা হয়। স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও স্কটল্যান্ডের বিস্তীর্ণ ভঙ্গিল পার্বত্য অঞ্চলে এইরূপ ভূমিরূপের যথেষ্ট নিদর্শন মেলে।

(3) ইনসেলবার্জ (Inselberg): গ্রানাইট শিলায় গঠিত তৃতীয় প্রকার ভূমিরূপ হল—ইনসেলবার্জ। গ্রানাইট শিলায় গঠিত বিভিন্ন আকার বা আকৃতির অবশিষ্ট পর্বতসমূহকে ইনসেলবার্ড বলা হয়। গ্রানাইট শিলা গঠিত অংশ বা উচ্চভূমি আবহবিকার তথা যান্ত্রিক আবহবিকারের মূলত শঙ্কমোচন প্রক্রিয়ার দ্বারা ক্রমশ ক্ষয়ীভূত ও স্থালিত হয়ে যে প্রায় গম্বুজাকৃতির পাহাড়ে পরিণত হয়, তাকেই ইনসেলবার্গ বলা হয়। জার্মান ভাষায় Insel শব্দের অর্থ island, দ্বীপ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার bery শব্দের অর্থ Hill বা পাহাড়। অর্থাৎ, ইনসেলবার্জ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল দ্বীপীয় পাহাড় বা বিচ্ছিন্ন পাহাড় | এইবুপ ইনসেলবার্জ আবহবিকারের দ্বারা আরো ক্ষারীভূত হয়ে যখন ক্ষুদ্রাকৃতির গম্বুজে পরিণত হয়, তখন তাকে বোর্নহার্ড বা ক্যাসেলকপিজ বলে। ইনসেলবার্জ 

(4) টিলা (Crag) : গ্রানাইট শিলায় গঠিত পরবর্তী ভূমিরূপ হল টিলা। পাঙালিক আগ্নেয় শিলা গ্রানাইটের মধ্যে প্রচুর ারণ (joints) সৃষ্টি হলে, সেই দারণগুলির মধ্যে দিয়ে আম্লিক প্রকৃতির দ্রবণ নীচের দিকে নেমে এসে আবহবিকারগ্রস্ত সামগ্রিক পদার্থসমূকে অপসারিত করে যে অতি স্বল্প উচ্চতা বিশিষ্ট উচ্চভূমির সৃষ্টি করে, তাকেই টিলা বলা হয়। ইনসেলবার্জকে অনেকেই টিলার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। কিন্তু ইনসেলবার্ড-এর উচ্চতা টিলার থেকে তুলনামূলকভাবে বেশি। ইংল্যান্ডের ডার্টমোর (dartmoor) টিলার উদাহরণসহ বহু সমীক্ষায় টিলার প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় মামাভাগ্নে পাহাড়ে এইরূপ টিলার অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। 

(5) ক্ষয়জাত গর্ত (Erosional Hollow): গ্রানাইট শিলায় আবহবিকারের ফলে গঠিত অন্যতম প্রধান ভূমিরূপ হল ক্ষয়জ্ঞাত গর্ত। গ্রানাইট শিলা ক্রমাগত আবহবিকারের মধ্যে দিয়ে ভূপৃষ্ঠে উন্মোচিত হওয়ার পর, এই শিলার উপরে বিষম প্রকৃতির রাসায়নিক আবহবিকারের প্রভাবে শিলা মধ্যস্থ ফেল্ডম্পার ও অভ্র খনিজ দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে ও অপসারিত হয়ে যে গর্তের ন্যায় ভূমিরূপ সৃষ্টি করে, তাকেই ক্ষয়জাত গর্ভ বলে। আরাবল্লী পর্বতের নানান অংশে এই ধরনের ভূমিরূপের যথেষ্ট নিদর্শন মেলে। 

(6) টর (Tor) : গ্রানাইট শিলায় গঠিত এক প্রকার বিশেষ ভূমিরূপ হল টর। 1955 সালে লিন্টন বলেন যে ক্রান্তীয় অঞ্চলের অনুরূপ আবহবিকার কার্যের মধ্যে দিয়ে প্রারম্ভিক পর্যায়ে কোরস্টোন গঠিত হয় এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে টরের সৃষ্টি হয়। গ্রানাইট শিলা গঠিত অংশে দারণ বা ফাটলের উপস্থিতি থাকলে তার মধ্যে দিয়ে জল প্রবাহিত হয়ে রাসায়নিক আবহবিকারের দ্বারা শিলার বাবা অংশ দ্রাবকে মিশে গিয়ে অপসারিত হয়ে শিলার ক্ষয় পরিসাধন করে ও দারণ ও ফাটলের আকার ও আয়তন বৃদ্ধি করে। এইভাবে শিলার ক্ষয়জাত পদার্থসমূহগুলি জলধারার সঙ্গে পরিবাহিত হয়ে গিয়ে যে বৃহৎ দারণ ও ফটিলমুক্ত অক্ষয় প্রাপ্ত কঠিন অংশগুলি দাঁড়িয়ে থাকে তাকেই অস্তাগ্রস্তর (corestone) বলে। এই অন্তঃপ্রস্তরের উপর রাসায়নিক আবহবিকার অতি ক্রিয়াশীল হলে তার মধ্যেকার সূক্ষ্ম পদার্থসমূহ তথা কাদা, বালি ও পলি ভাবকের মধ্যে ভাবা হয়ে দ্রবণ দৃষ্টি করে ও অপসারিত হয়। এই ক্ষেত্রে রাসায়নিক আবহবিকারের তীব্রতার দরুন বিভিন্ন বৃহৎ আকৃতির দারণ ও ফাটলগুলি পরস্পর যুক্ত হয়ে বৃহৎ বৃহৎ ফাঁকা স্থান সৃষ্টি করে। এইরূপ সামগ্রিক অবস্থার ফলে অন্তঃপ্রস্তরের যে অক্ষয়প্রাপ্ত অংশগুলি দণ্ডায়মান থাকে, তাকেই টর বলে। প্রাফাইট শিলাগঠিত অঞ্চলে টর পার্শ্ববর্তী তরঙ্গায়িত ভূমিরূপ থেকে প্রায় ৬ মিটার থেকে 20 মিটার পর্যন্ত উঁচু হয়ে থাকে। টরকে আবার অবস্থানের বিচারে মূলত দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা -


(a) আকাশরেখা টর (Skyline Tor): এই প্রকার টর উচ্চভূমির মস্তকদেশে বা জলবিভাজিকা অংশে লক্ষ করা যায়। এই প্রকার টর আংশিক গোলাকার বিশিষ্ট হয়। 

(b) উপ-আকাশরেখা টর (Sub-Skyview Tor) : এই প্রকার টর সাধারণত উপত্যকার পার্শ্বদেশে লক্ষ করা যায়। এই প্রকার টর সাধারণত গোলাকার প্রকৃতির হয়ে থাকে। 

(7) ঢালযুক্ত ভূমিরূপ (Slope Topography) : গ্রানাইট শিলায় গঠিত অন্যতম ভূমিরূপ হল ঢালযুক্ত ভূচিত্র। সাধারণত গ্রানাইট শিলা গঠিত বহু উচ্চভূমি অংশ গভীরভাবে ব্যবচ্ছিন্ন হলে যে শুধুমাত্র রৈখিক ঢালযুক্ত ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, সেই ভূমিরূপকে ঢালযুক্ত ভূমিরূপ বলা হয়। এইরূপ ভূমিরূপে উপত্যকার তলদেশে বা শৈলশিরার উপরে কোনো স্থানেই সমভূমি লক্ষ করা যায় না। মিশরের সিনাই উপদ্বীপে, দক্ষিণ আমেরিকার সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালার পূর্ব অংশে নিবিড়ভাবে ঢালযুক্ত ভূমিরূপের অস্তিত্ব মেলে। 

(8) সমভূমি (Plains) : আয়তনের ও বৈশিষ্ট্যতার বিচারে গ্রানাইট শিলায় গঠিত সর্বাপেক্ষা সাধারণ প্রকৃতির ভূমিরূপ হল সমভূমি। সাধারণত মালভূমির পরবর্তী নিম্নদিকে প্রসারিত সামগ্রিক ভূভাগই সমভূমি নামে পরিচিত। ভূমিরূপ বিজ্ঞানী টুইডেল (Twidalle) গ্রানাইট শিলার গঠিত চার ধরনের সমভূমিকে চিহ্নিত করেছেন। এই সমভূমিগুলি হল– (a) পেডিমেন্ট, (b) শিলা পেডিমেন্ট, (c) সমপ্রায়ভূমি ও (d) পেডিপ্লেন। উপরিউক্ত প্রধান ভূমিরূপগুলি ছাড়াও গ্রানাইট শিলাগঠিত অঞ্চলে আবহবিকারজনিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গ্রানাইট গম্বুজ, ভৃগু ও মস্তকভূমি, এচপ্লেন, পিট, প্যান, মৌচাক সদৃশ ভূমিরূপ, রিল ও কাসকেড প্রভৃতি ক্ষুদ্রাকৃতির ভূমিরূপ বিশিষ্ট রূপে গড়ে ওঠে। 

★ব্যাসল্ট শিলায় গঠিত ভূমিরূপ Landforms on Basalt
 ব্যাসন্ট হল নিঃসারী ক্ষারকীয় প্রকৃতির আগ্নেয়শিলা। ভূগর্ভের ফাটল বা ছিদ্রপথ দিয়ে ভূ-অভ্যন্তরস্থ উত্তপ্ত ম্যাগমা লাভা রূপে ভূ-অভ্যন্তরের বাইরে ভূপৃষ্ঠে বেরিয়ে বায়ুর সংস্পর্শে এসে দ্রুত শীতল ও কঠিন হয়ে ব্যাসল্টের জন্ম দেয়। ব্যাসল্ট বুত জমাটবন্ধতার মধ্যে দিয়ে সৃষ্টি হয় বলে ব্যাসন্টের কণাগুলি খুবই সূক্ষ্ম প্রকৃতির হয়ে থাকে। সাধারণত চুনধর্মী প্ল্যাজিওক্লেজ ও পাইরক্সিন খনিজের সমন্বয়ে প্রাথমিকভাবে ব্যাসল্টের জন্ম হয়। এছাড়াও লোহা, ইলমেনাইট, হর্নব্লেন্ড ও অলিভিন প্রভৃতি খনিজের অস্তিত্বও ব্যাসল্টের মধ্যে মেলে। ব্যাসল্ট শিলার মধ্যে বহু বহুভুজাকৃতির দারণের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিমে কলম্বিয়া নদী অববাহিকার প্রায় 2.65 লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকা এবং ভারতের দাক্ষিণাত্যের মালভূমির প্রায় 5.18 লক্ষ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল ব্যাসন্ট শিলাদ্বারা গঠিত। ব্যাসন্ট জাতীয় প্রাকৃতিক ভূগোল শিলার জন্মের সময়ে এবং এই শিলার উপর বিভিন্ন প্রাকৃতিক ক্ষয়কারী শক্তির ক্রিয়াশীলতার মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়ে থাকে। নিম্নে এই প্রকার ভূমিরূপগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল

[ 1 ] লাভা মালভূমি (Lava Plateau) : ব্যাসল্ট শিলায় গঠিত প্রথম তথা প্রারম্ভিক ভূমিরূপ হল লাভা মালভূমি। সাধারণ বৃহদাকৃতির দারণ বা ফাটলের মধ্য দিয়ে বন্যার ন্যায় ভূ-অভ্যন্তরের ক্ষারকীয় ম্যাগমা, লাভারূপে ভূপৃষ্ঠে ক্রমশ প্রবাহিত হয়ে যে মালভূমির ন্যায় ভূভাগের সৃষ্টি করে, তাকেই লাম মালভূমি বলে। সাধারণত অসংখ্য একক লাভাপ্রবাহ, এদের মধ্যবর্তী স্তর বা পাইরোক্লাস্ট ও পাললিক শিলার সংকীর্ণ স্তর নিয়ে এই লাভা মালভূমির সৃষ্টি হয়। লাভা মালভূমির উপরিঅংশ সাধারণত চ্যাপ্টা প্রায় সমতল বা তরঙ্গায়িত প্রকৃতির ও চারপাশ খাড়া সোপান বা ধাপযুক্ত হয়ে থাকে। সাধারণত পাতে পাতে লাভা সঞ্চায়ের মধ্যে দিয়ে লাভা মালভূমির সৃষ্টি হয় বলে এর চারপাশে ধাপ বা সিঁড়ির জন্ম হয়। লাভা মালভূমির উপরিতালে অনেক সময় বহু ক্ষুদ্রাকৃতির লাভা মালভূমি গ্রানাইট গঠিত পর্বত (Steptoes) এর অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। এছাড়া লাভা মালভূমির উপরে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র 'বিস্ফোরণ শব্লু' থাকতে পারে। ক্ষয়ের পরবর্তী সময়ে লাভা মালভূমির ভুগতে অসংখ্য ক্ষুদ্রাকার ধাপ বা গঠনমূলক মঞ্চের উদ্ভব হয়ে থাকে। কলম্বিয়া, কলোরাডো ও পূর্ব আফ্রিকার বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে ও ভারতের দাক্ষিণাত্যের উত্তর পশ্চিমে এই প্রকার লাভা মালভূমি লক্ষ করা যায়। ভারতের দাক্ষিণাত্যের লাভা মালভূমি 'ডোনট্যাপ' (deccan trap) নামে পরিচিত। ব্রাজিলের পারানা ব্যাসন্ট ফ্ল্যাট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া নদী অববাহিকা ও অইসল্যান্ড লাভা মালভূমির প্রকৃষ্ট 


[ 2 ] লাভা সমভূমি (Lava Plains): ব্যাসন্ট শিলায় গঠিত দ্বিতীয় ভূমিরূপ হল লাভা সমভূমি। সাধারণত বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে স্বল্প লাভাস্রোতের মাধ্যমে যে প্রায় সমতলভূমির সৃষ্টি হয়, তাকেই লাভা সমভূমি বলে। আবার অন্যভাবে বলা যায়, ভূত্বকের বিভিন্ন ফাটলের মধ্যে দিয়ে ভূ-অভ্যন্তরস্থ অতি তরল ম্যাগমা, ভূপৃষ্টে লাভারূপে প্রবাহিত হয়ে যে প্রায় সমতলক্ষেত্রের সৃষ্টি করে, তাকেই লাভা সমভূমি বলে। লাভা সমভূমির উপর অনেক সময় বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিবি বা নোলস্, গহবর ও নানাপ্রকার প্রবাহতলের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের স্নেক ভ্যালি (snake valley) লাভা সমভূমির প্রকৃষ্ট উদাহরণ। 

[ 3 ] লাভা গম্বুজ (Lava Dome) : ব্যাসল্ট শিলায় গঠিত তৃতীয় ভূমিরূপ হল লাভা গম্বুজ। ভূ-অভ্যন্তরের তরল ম্যাগমা ভূপৃষ্ঠে লাভারূপে প্রবাহিত হয়ে, বায়ুর সংস্পর্শে এসে ক্রমশ শীতল হয়ে যে উত্তলাকৃতির গম্বুজের ন্যায় ভূমিরূপের সৃষ্টি করে, তাকেই লাভা গম্বুজ বলে। গম্বুজাকৃতি আকৃতির জন্যই এই ভূমিরূপটির এরূপ নামকরণ। ভূ-অভ্যন্তরের তরল লাভা সহজে দূরবর্তী স্থানে প্রসারিত হয়ে লাভা শিল্ডের গঠনের পরিবর্তে লাভা গম্বুজ সৃষ্টি করে থাকে। হাওয়াই দ্বীপের মৌনাকেয়া (muriakea) এইরূপ লাভা গম্বুজের বিশিষ্ট উদাহরণ। লাভা গম্বুজ মূলত দুই প্রকারের হয়ে থাকে। যখীল (a) বৃহদাকৃতির লাভা গম্বুজ ও (b) ক্ষুদ্রাকৃতির লাভা গম্বুজ। লাভা গম্বুজের কেন্দ্রীয় অংশে কেন্দ্রমুখী জলনির্গমের ফলে বা, বৃষ্টির জল জমে ক্ষুদ্র হ্রদের সৃষ্টি হয়ে থাকে। এই প্রকার হ্রদের বাইরের দিকের ঢালে কেন্দ্রবিমুখ জলনির্গম প্ৰণালীৰ জন্ম হয়ে থাকে। 

[ 4 ] বৈপরীত্য ভূমিরূপ (Inversion of Relief) : বৈপরীত্য ভূমিরূপ হল ব্যাসল্ট শিলায় গঠিত অন্যতম প্রধান ভূমিরূপ শৈলশিরা ও উপত্যকা দ্বারা গঠিত বিস্তীর্ণ অংশে বিভিন্ন ফাটল বা ছিদ্রপথের মধ্যে দিয়ে ভূ-অভ্যন্তরস্থ ম্যাগমা ভূপৃষ্ঠে লাভা রূপে নির্গত হয়ে উপত্যকা বরাবর বিস্তৃতি লাভ করে। এর পরবর্তী সময়ে বায়ুর সংস্পর্শে এসে এই বিস্তৃত লাভা। শীতল ও কঠিন হয়ে সমগ্র উপত্যকা অধিকার করে নেয় ও উপত্যকার উচ্চতা বৃদ্ধি করে। এই প্রকার শিলা অত্যন্ত ক্ষ প্রতিরোধক বলে সামগ্রিক উপত্যকার বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রটি যথেষ্ট ক্রয় প্রতিরোধক হয়ে ওঠে। কিন্তু শৈলশিরাসমূহ পাললিকশিলা দ্বারা গঠিত হওয়ায় তার মধ্যে কম ক্ষয় প্রতিরোধক শক্তি গড়ে ওঠে। এর ফলে শৈলশিরাসমূহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক ক্ষয়কারী শক্তির দ্বারা উপত্যকা অংশের থেকেও বেশি ক্ষয়ীভূত হয়ে উপত্যকা অঞ্চলের নিম্নে অবস্থান করে। এর ফলে উপত্যকা অঞ্চল শৈলশিরা অংশসমূহের যথেষ্ট অধিক উচ্চতায় বিরাজ করে। এর ফলে সামগ্রিক ভূচিত্রে এরা বিপরীতধর্মী অবস্থার মধ্যে দিয়ে বিপরীতধর্মী ভূমিরূপে প্রকাশ পায়, এই প্রকার বিপরীত অবস্থার ভূমিরূপকেই বৈপরীত্য ভূমিরূপ বলা হয়।

[ 5 ] লাভা মাউন্ড (Lava Mounds) : ব্যাসল্ট শিলায় গঠিত এক বিশেষ ভূমিরূপ হল লাভা মাউন্ড। সাধারণত যে সমস্ত লাভা গম্বুজের ন্যায় বাসিন্ট আগ্নেয়গিরিতে কোনো জ্বালামুখের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায় না, সেই সমস্ত লাভা গম্বুজের ন্যায় ব্যাসল্ট আগ্নেয়গিরিগুলিকে লাভা মাউন্ড বলে। অনেকেই লাভা গম্বুজের সঙ্গে লাভা মাউন্ডকে গুলিয়ে ফেলে। লাভা গম্বুজে বেশ কিছু জ্বালামুখের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়, কিন্তু লাভা মাউন্ডে কোনো জ্বালামুখের নিদর্শন পাওয়া যায় না। ভিক্টোরিয়া প্রদেশের মাউন্ট কটেরিল (Mt. Cotterill) লাভ| মাউন্ডের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। 

[ 6 ] কুয়েস্তা (Cuestas) : ব্যাসন্ট শিলাদ্বারা গঠিত ষষ্ঠ ভূমিরূপ হল কুয়েস্তা। সাধারণত ব্যাসন্ট শিলাগঠিত ভূভাগের প্রান্তভাগে দারণযুক্ত খাড়া প্রকৃতির ভৃগুতটে নানান প্রকার আবহবিকার, ক্ষয়কার্য, ভরসঞ্চালন, পুর প্রভৃতি ক্রিয়ার দরুন ভৃগুতটের ক্ষয়ের মাধ্যমে পশ্চাদপসরণ ঘটে। এর পরবর্তী সময়ে আলোচ্য প্রক্রিয়াসমূহ ক্রমাগত সংঘটিত হতে থাকলে একদিকে যথেষ্ট খাড়া ঢালবিশিষ্ট ও অপরদিকে বেশ মৃদু প্রকৃতির ঢালবিশিষ্ট যে ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়, সেই ভূমিরূপকে কুয়েস্তা বলা হয়। 


[ 7 ] মেসা ও বিউট (Mesas and Buttes): ব্যাসন্ট শিলায় গঠিত অন্যতম প্রধান ভূমিরূপ হল মেসা ও বিউট। লাভা মালভূমির বিস্তীর্ণ অংশে ও বিশেষত প্রান্তভাগে তীব্র আবহবিকার ও অন্যান্য প্রাকৃতিক ক্ষয়কারী শক্তির দ্বারা যথেষ্ট হারে ক্ষয় পরিসাধিত হয়ে যে বিচ্ছিন্ন অক্ষয়প্রাপ্ত স্বল্প উচ্চতা ও খাড়া ঢালবিশিষ্ট প্রায় টেবিলপ্রকৃতির অবশিষ্ট ভূমিরূপের জন্ম হয়, তাকে মেসা বলা হয়। এই প্রকার মেসার উপর প্রাকৃতিক ক্ষয়কারী শক্তির ক্রিয়াশীলতার প্রভাব উত্তরোত্তর বর্ধিত হলে মেসা ক্রমাগত ক্ষয়িত হয়ে যে অভিস্বর উচ্চতাবিশিষ্ট অবশিষ্ট ক্ষুদ্র আকৃতির উচ্চভূমির জন্ম দেয়, তাকে বিউট বলা হয়। কুয়েস্তা, মেসা হগব্যাক

[ 8 ] প্রান্তশিলা (Rim Rocks) : ব্যাসন্ট শিলায় গঠিত অষ্টম সংখ্যক ভূমিরূপ হল প্রান্তশিলা। প্রাপ্তশিলা এক ক্ষুদ্ররূপ বিশিষ্ট ভূমিরূপ হওয়ায় এই ভূমিরূপটিকে অনেকেই আলোচনার মধ্যে রাখেনি। মেসা বা বিউটের লাভা দ্বারা আচ্ছাদনের সীমানায় যে উল্লঙ্গ বা প্রায় উল্লম্ব ভুগ্ম ঢালের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়, তাকেই প্রাপ্তশিলা বলা হয়। এই প্রাপ্তশিলা এক প্রকার বিশেষ ঢালবিশিষ্ট ভূমিরূপ। | 
★চুনাপাথর শিলাঞ্চলে গঠিত ভূমিরূপ Landforms on Limestone

বৃষ্টির জল এবং প্রবাহিত জলধারা চুনাপাথর এবং ডলোমাইট বা চক দিয়ে গঠিত অঞ্চলে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিরূপ গঠন করতে পারে।

 ● পৃষ্ঠীয় ভূমিরূপ (Surface Landform) 

(1) টেরারোসা (Terrarossa) : 'টেরা' শব্দের অর্থ হল মাটি এবং ‘রাসা' শব্দের অর্থ হল লাল মাটি। যা একধরনের অবিশুদ্ধ চুনাপাথর দ্বারা গঠিত। অপেক্ষাকৃত কম ঢালযুক্ত অঞ্চলে ক্রমাগত দূরণ ক্ষয়ের জন্য চুনাপাথর নীচের দিকে অপসারিত হয়। কিন্তু অদ্রাব্য পাথর ও লৌহজাত পাথর জমাট বেঁধে যে লাল রঙের মাটির সৃষ্টি করে তাকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের টেরারোসা বলে। এই অঞ্চলে ভৌম জালের কার্যের ফলে এক ধরনের লাল আগ্নিক কাদা আবরণের সৃষ্টি হয়। আৰ্দ্ৰ ক্রান্তীয় অঞ্চলে এঁকে দেখতে ল্যাটেরাইট মাটির মতো হয়। এই মাটির গভীরতা কয়েক মিটার পর্যন্ত হতে পারে। এই মাটি ভূপৃষ্ঠকে আবৃত করে রাখে।

(2) ল্যাপিস ও কারেন (Lapies and Karren) : কোনো বিস্তীর্ণ উন্মুক্ত চুনাপাথর অঞ্চলকে বৃষ্টির জল পতিত হলে শিলায় ফাটল ও ছিল পথে ওই হল নীচের দিকে প্রবাহিত হয়। এই ধরনের নিম্নগামী জালের প্রবাহের ফলে শিলা অতিদ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং ছিদ্রগুলি ধীরে ধীরে প্রশস্ত হয়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ছিদ্রগুলি। প্রশত হয়ে গভীর খাতের সৃষ্টি করে। অনেকগুলি গর্তের মধ্যবর্তী অংশ সৰু টিলার ন্যায় ভুমিরূপের সৃষ্টি করে। ফরাসি ভাষায় একে ল্যাপিস এবং জার্মান ভাষায় একে কারেন বলে। কারেন বিভিন্ন কারেন প্রকারের হতে পারে। যথা- (a) বিলেন কারেন, (b) রিজেন কারেন এবং (c) ট্রিট কারেন ।


(3) গ্লাইক ও ক্লিন্ট  : কার্বনিক অ্যাসিড মিশ্রিত বৃষ্টির জলের দ্রবণের ফলে চুনাপাথর অঞ্চলের দারণ বা সংযুক্তিগুলি ক্ষা পেয়ে গভীর হতে থাকে এবং আয়তনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরস্পরচ্ছেদী এরুপ দারণগুলি সম্প্রসারিত হয়ে সংকীর্ণ লম্বা খাত এবং তার মধ্যবর্তী অংশে সংকীর্ণ সূচালো উচ্চভূমি বা আল সৃষ্টি করে। দীর্ঘ ও গভীর খাতগুলিকে ফ্রান্সে ল্যাপিয়ে, ইংল্যান্ডে গ্রাইক এবং জার্মানিতে কারেন বলে। গ্রাইকের মধ্যবর্তী সমতল সুচালো উচ্চভূমিকে ক্লিন্ট বলে। ভারতের যুগ জেলার 2 km উপরে নান্দনী যনি অঞ্চলে গ্রাইক ও ক্লিন্ট সৃষ্টি হয়েছে। যে সমস্ত গ্রাইকের দৈর্ঘ্য 10 মিটারের বেশি, প্রস্থ 4 মিটার এবং গভীরতা ১ মিটার তাকে বোগাজ বলে। 

● অবনমিত ভূমিরূপ (Depositional Landform) 

(1) সিল্কহোল (Sink Hole) চুনাপাথর অঞ্চলে প্রাথমিক অবস্থায় দ্রবণ ক্ষয়ের ফলে অসংখ্য ছোটো ছোটো গর্ভের সৃষ্টি হয়। এদের সিঙ্কহোল বলে। কার্স্ট ভূমিরূপ অঞ্চলে সিঙ্কহোল একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিরূপ। এই ভূমিরূপের আকার এবং গভীরতা বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন হয় তবে অধিকাংশ সিল্কহোলের আকৃতি ফানেলের মতো হয় এবং এদের মুখটি যথেষ্ট প্রশস্ত হয়। সিঙ্কহোলগুলি সাধারণত 3-10 মিটার গভীরতা এবং আয়তন কয়েক বর্গ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। যে সমস্ত চুনাপাথর অঞ্চলে দারণের সংখ্যা বেশি থাকে, সেখানে সিঙ্কহোল উপরের দিকে বেশি ক্ষ্যা করে এবং ক্ষয়জাত পদার্থ নীচের দিকে অপসারিত হয়। উৎপত্তি অনুসারে সিঙ্কহোলকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—ভোলাইন এবং এস সিল্ক।

( 2 ) সোয়ালো হোল (Swallow Hole): যদি সিঙ্কহোলের উপর মাটির আবরণ না থাকে এবং জল ভূপৃষ্ঠ থেকে সরাসরি কারণ বা গর্ত দিয়ে ভূগর্ভে চলে যায় তখন তাকে সোয়ালো হোল বলে। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের জলপ্রবাহ ভূ-অভ্যন্তরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করার ফলে সৃষ্ট উন্মুক্ত গহ্বরকে সোয়ালো হোল বলে। ইংল্যান্ডের 'গ্যালিং মাইল' নামক সোয়ালো হোলটির গভীরতা প্রায় 1100 মিটার। সোয়ালো হোল অনেকটা সরু খালের মতো দেখতে হয়। কুমায়ূন হিমালয়ের দেরাদুনে অসংখ্য সোয়ালো হোল দেখতে পাওয়া যায়। সোয়ালো হোল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন পুইট (Puit), আভেন (Aven), গুফে (Gufre)। 

(3) পোনর (Ponor): চুনাপাথর যুক্ত সোয়ালো হোল দিয়ে বৃষ্টির জল যে পথে প্রবেশ করে, সেই পথকে পোনর বলে। অর্থাৎ চুনাপাথর যুক্ত অঞ্চলে কাল্পনিক অ্যাসিড মিশ্রিত ক্ষয়রোধের ফলে গঠিত গর্ত বা সোয়ালো হোলগুলি দিয়ে জল যে নলাকৃতি পথে ভূগর্ভে প্রবেশ করে, সেই পথগুলিকে পোনর বলে। এই ধরনের পথগুলি উল্লম্ব এবং অত্যন্ত খাড়া ঢালঘুক্ত হয়। 



(4) ডোলাইন (Doline): কাস্ট অঞ্চলের অবনমিত ভূমিরূপগুলির মধ্যে একটি অন্যতম হল ডোলাইন। সার্ভেয়ান শব্দ 'ডোলিনা' থেকে 'ডোলাইন' শব্দটি এসেছে। যার অর্থ ভূমিরূপের মধ্যে এক অবনমন। তাই ডোলাইন প্রকৃত পক্ষে সিঙ্ক হোলের নামান্তর। দীর্ঘদিন ধরে চুনাপাথর | যুক্ত অঞ্চলে দ্রবণ ও ক্ষকার্যের ফলে সোয়ানো হোলগুলি ক্রমশ প্রসারিত হতো বড়ো গর্তে পরিণত হয় এই বড়ো গর্তগুলিকে ঢোলাইন বলে। প্রকৃতপক্ষে ডোলাইনগুলি এক ধরনের বৃত্তাকার বা উপবৃত্তাকারে আবদ্ধ নিম্নভূমি। এদের গভীরতা 1 থেকে 100 মিটার এবং আয়তন 60 থেকে 1000 বর্গমিটার। সাধারণত দাবণযুক্ত বিশুদ্ধ চুনাপাথর গঠিত সমতল অঞ্চলে কিংবা শুদ্ধ নদী উপত্যকায় ডোলাইন সৃষ্টি হয়। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এদের গভীরতা, আয়তন, সংখ্যা এবং ফল বাড়তে থাকে। ডোলাইন বিভিন্ন কারণে হতে পারে। যথা-ভূপৃষ্ঠের শিলান্তরে দ্রবীভূত হয়ে প্রবণ ডোলাইন কিংবা গুহার ছাদ ধসে গিয়ে ধস ডোলাইন প্রভৃতি। রোরাগুহা রেলস্টেশনের বিপরীত পাশে রোরাগুহা ফানেলের আকৃতির গর্ভটি একটি আদর্শ ডোলাইন। এছাড়াও আড্রিয়াটিক উপকূলে অসংখ্য ডোলাইন দেখতে পাওয়া যায়। উৎপত্তি অনুসারে ডোলাইনকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়- (a) প্রবণ ডোলাইন, (b) ধর্ম ডোলাইন (c) দ্রবণ-পাইপ ডোলাইন, (d) অবনমিত ডোলাইন (e) ককপিট ডোলাইন। 


(5) দ্রবণ প্যান (Solution Pan) সমান্তরালভাবে বিন্যস্ত চুনাপাথরের স্তরে ভবণের ফলে উৎপন্ন গর্তগুলি আকারে বড়ো ও গভীর হলে তাকে প্রবণ প্যান বলে। এই গর্তগুলি প্রশস্ত ও বৃহদাকার হয়। প্রকৃতপক্ষে প্রথম প্যান হল ডোলাইনের একটি পরিবর্তিত রূপ যা ডোলাইনের তুলনায় অগভীর এবং বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ও ইন্ডিয়ানা প্রদেশে উচ্চ নদী অঞ্চলে একটি দ্রবণ প্যানের সৃষ্টি হয়েছে।

(6) কার্স্ট হ্রদ (Karst Lake) : ডোলাইনের তলদেশে জলধৌত কাদা সজ্জিত হয়ে ওর মধ্য দিয়ে ভূপৃষ্ঠের জল ভূগর্ভে প্রবেশ করতে পারে না। তখন সেই ডোলাইনের মধ্যে জল জমে জলাশয় বা হ্রদের সৃষ্টি হয়। এই ধরনের হ্রদকে কার্স্ট হ্রদ বলে। ভৌম জলস্তরের উপরে এই ধরনের জলের সঞ্জয় একটি ক্ষুদ্রাকার কার্স্ট হ্রদ বা সিঙ্কহোল পুকুর গঠন করে। কার্স্ট হ্রদগুলির জলতল ভৌম জলের উর্ধ্বসীমার সলো একই হলে অবস্থান করে।

(7)কার্স্ট জানালা (Karst Window): ভূবিজ্ঞানী ম্যালভের মতে, চুনাপাথর অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ নদী সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই গর্ভস্থ নদীর গতিপথে ভূপৃষ্ঠের ধসের ফলে কিংবা মুড়ঙ্গের ছাদ ধসে যাওয়ার ফলে গঠিত। কোনো প্রতিবন্ধকের ভেতর দিয়ে ওই নদীটিকে একটি গুহার থেকে বেরিয়ে অপর একটি গুহার মধ্যে প্রবেশ করতে দেখা গেলে, তাকে কার্স্ট জানালা বলে। অর্থাৎ সুড়ঙ্গের ধসে যাওয়া যে অংশ দিয়ে ভূপৃষ্ঠ থেকে ভূগর্ভস্থ নদীকে দেখা যায়, তাকে ফার্স্ট জানালা বলে। অন্ধ্রপ্রদেশের বোরা গুহা থেকে গোমানী নদীর প্রবাহকে দেখা যায়। ভূগর্ভে প্রবাহিত নদী বসের জন্য সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে একটি গর্ভ থেকে ভূপষ্ঠে বেরিয়ে আসে এবং অপর একটি গর্ভের মধ্য দিয়ে পুনরায় ভূগর্ভে প্রবাহিত হয়। 

(8) উভালা (Uvala) : ডুবিজ্ঞানী রে (Wray, 1922)-এর মতে বসনিয়াতে ব্যবহৃত এই শব্দের অর্থ খাড়া প্রান্ত, চওড়া ও প্রশস্ত তলদেশ বিশিষ্ট বিশালাকার নিম্নভূমি। যেটি মুলত ছাদ ধসে তৈরি হয় এটি উভালা নামে পরিচিত। আবার মিজিক (Cvigic, 1960)-এর মতে, অনেকগুলি সিঙ্কহোল সংযুক্তির ফলে গঠিত যৌগিক সিঙ্কহোলকে উদ্ভালা বলে।
অর্থাৎ ডোলাইনগুলি জল মিশ্রিত CO²-র প্রভাবে দীর্ঘদিন বাণী ক্ষয়প্রাপ্ত হতে হতে ক্রমশ বড়ো হয়ে যে বিশাল গুহা বা গর্ভের সৃষ্টি করে তাকে উভালা বলে। অনেক সময় জল মিশ্রিত CO²-র দ্বারা গুহার ছাদ ধসে পড়লে যে বিরাট গর্ভের সৃষ্টি হয় তাকে উদ্ভালা বলে কিংবা ধসের ফলে দুই বা ততোধিক ডোলাইন একত্রে মিশে যে বিশাল গহ্বরের সৃষ্টি করে। তাকে উভালা বলে। এগুলির ব্যাস 4-5 km হয়। চারপাশের প্রান্তভাগে চুনাপাথর গঠিত বন্ধুর ও ভগ্নপ্রায় এবং মাঝে মাঝে উচ্চভূমির মতো অবশিষ্ট চুনাপাথরের ঢিবি উভালায় দেখা যায়। চুনাপাথরের শিলাস্তরে পরপর সজ্জিত ফাটলের প্রসারণকে বলে রৈখিক আকৃতির উভালা (longated uvala) বলে। আবার দ্রবণ কূপের সংযুক্তির ফলে যে ধরনের উভালা তৈরি হয়, যা যৌগিক উভালা (compound ovala) নামে পরিচিত। উভালার মধ্য দেশে কোনো পৃষ্ঠপ্রবাহ থাকে না। বৃষ্টির সমস্ত জল ভূ-অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করে। সেই সঙ্গে খাড়া পার্শ্বদেশগুলি ক্রমশ নীচু হয়।

(9) পোলজি (Polje) : উভালা থেকে বড়ো আয়তনের অবনমিত নীচু, প্রায় বড়ো আয়তনের সমতল ভূমি ও খাড়া পাড়যুক্ত ভূমিরূপগুলি পোলজে নামে পরিচিত। চুনাপাথর গঠিত অঞ্চল জল মিশ্রিত কার্বনিক অ্যাসিডের ক্ষয়কার্যের ফলে গঠিত বিশালাকৃতির শুদ্ধ উভালাগুলিকে পোলাজ বলে। কিন্তু এর গঠন সম্পর্কে বিভিন্ন বিজ্ঞানী বিভিন্ন মত পোষণ করেছেন। অনেকের মতে, ভূ-অভ্যন্তরে জলের অনুপ্রবেশের ফলে জল ও পাথরের দ্রবণ কার্যের ফলে বিশালাকৃতির গুহার ছাদ ধসে পৌলজের সৃষ্টি হয়েছে। আবার Trudgill-এর মতে, পোলঞ্জের গঠন এবং খাড়া পার্শ্বদেশ চ্যুতির দ্বারা গঠিত। যাইহোক এর মধ্যভাগ খুব সমতল, মধ্যভাগে পৃষ্ঠ প্রবাহযুক্ত নদীবিন্যাস দেখা যায় এবং আবহবিকারের ফলে সৃষ্ট গভীর কর্নমের স্তর দ্বারা আবৃত থাকে। বসনিয়া-হার্জেগোভিনার লিভানো পোলজে প্রায় 65 km লম্বা এবং 5-11 km চওড়া। ছত্তিশগড়ের রায়পুর রাস্তার সড়কের উপর ধামতারিতে পোলতে দেখা যায়। অনেক সময় পোলজের মধ্যে জল জমে পোলজে হ্রদের সৃষ্টি হয়। 
(10) হামস্ (Hums): চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলে জলের সঙ্গে কার্বনিক অ্যাসিডের বিক্রিয়ায় শিলার প্রবণ কার্যের ফলে পালবাজনী পোনর প্রায় সম্পূর্ণ অঞ্চল বসে গিয়ে যে পোলজের সৃষ্টি হয়, অনেক সময় এই পোলজের উপর চুনাপাথরের বিভিন্ন খন্ডগুলি সঞ্চিত হয়ে ছোটো ছোটো ঢিবি বা টিলার ন্যায় বা অবস্থান করে এগুলিকে হামস বলে। হামসকে কোথাও হেস্ট্যাক পাহাড় এবং কোথাও পেপিলো পাহাড় বলে। বারপুর জেলার কাদাপাথর গঠিত হামসগুলিকে স্থানীয় ভাষায় রাবণ ভাটা বলে। এই টিলাগুলির ঢাল অধিকাংশ ক্ষেত্রে 200-30° পর্যন্ত পোলজি ও হামদ হয়ে থাকে।


(11) কার্স্ট সমভূমি (Karst Plain): বিস্তীর্ণ চুনাপাথরযুক্ত অঞ্চলে বৃষ্টির জলে সৃষ্ট অসংখ্য সিঙ্ক হোলযুক্ত সমভূমিকে কার্স্ট সমভূমি বলে। এরূপ সমভূমি মৃদু ডালযুক্ত হয়। এই ধরনের ভূপ্রকৃতিকে সিঙ্কহোল সমভূমিও বলা হয়। এই কাস্ট সমভূমির ওপর দিয়ে প্রবাহের সময় কেবল বড়ো বড়ো নদী, যেগুলি গভীর নিম্নক্ষয়ের দ্বারা চুনাপাথরের স্তরকে এড়িয়ে চলে, সেগুলি ছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নদীগুলি ভূ-অভ্যন্তরে হারিয়ে যায়। 

(12) চুনাপাথরের মেঝে (Limestone Floor) চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলে অসংখ্য কারেন ও ক্লিন্টস গঠিত হলে অঞ্চলটি এবড়ো খেবড়ো বা বন্ধুর আকৃতি ধারণ করে। এই ধরনের ভূপৃষ্ঠকে চুনাপাথরের মেঝে বলে।

● নদী দ্বারা সৃষ্টি কাস্ট ভূমিরূপ (cast landform by fluvial erosion)

(1) অন্ধ উপত্যকা (Blind Valley) : কার্স্ট অঞ্চলের অন্ধ উপত্যকা শুদ্ধ উপত্যকা নদী সিল্কহোলে প্রবেশ করছে উপর দিয়ে প্রবাহিত নদী সিঙ্কহোলে প্রবেশ করলে মনে হয় যেন নদীটি হঠাৎ তার গতি হারিয়ে ফেলেছে। তাই নদীটির সিঙ্কহোল পর্যন্ত প্রসারিত অংশকে অন্ধ উপত্যকা বলে। অর্থাৎ চুনাপাথর যুক্ত অঞ্চলে ক্ষয়কার্য শুরু হওয়ার পর প্রথম পর্বে পৃষ্ঠদেশে নদী বিন্যাসের সৃষ্টি হয়। পরবর্তী পর্যায়ে দ্রবীভবনজাত কূপ, ডোলাইন, উভালার মধ্যে পৃষ্ঠদেশের নদী অধোগামী হয়, তখন উপরের শুষ্ক নদীখাতটি অন্ধ উপত্যকা রূপে বিরাজ করে। গুহার মুখ এবং এই উপত্যকায় নদীখাত দেখা যায় কিন্তু কোনো প্রবাহ থাকে না। কিন্তু, নদীর গতিপথের শেষ ভাগে রূপ, ডোলাইন কিংবা গুহার নদীটি অবলুপ্ত হয়। এই উপত্যকায় সিঙ্কহোল পর্যন্ত অঞ্চল জলেপূর্ণ থাকতে দেখা যায় এবং ক্ষয়কার্য বেশি হয় বলে উপত্যকাটি গভীর হয়। শুদ্ধ ও অন্য উপত্যকা 

(2) শুষ্ক উপত্যকা (Dry Valley) চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলে নদীর প্রবাহপথে সোয়ালো হোল, ডোলাইন, পোনর প্রভৃতি সৃষ্টি হলে নদীর জল এই সমস্ত গর্তের মধ্যে দিয়ে চুনাপাথরের গহ্বরে চলে যায়। ফলে উপরের নদী উপত্যকাটি জলের অভাবে শুকিয়ে যায় কিংবা বছরের বেশির ভাগ সময়ে জলশূন্য অবস্থায় থাকে। এই জলহীন উপত্যকাকে শুষ্ক উপত্যকা বলে। কিন্তু অনেক সময়ে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে জল সিল্কহোল দিয়ে ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে না পেরে শুষ্ক উপত্যকাকেই জলপূর্ণ করে রাখে। আবার, বর্ষা শেষ হয়ে গেলে পুনরায় সেই আগের অবস্থায় ফিরে আসে। বোরা ও কারেগুড়া অঞ্চলে এই ধরনের কতকগুলি শুষ্ক উপত্যকা লক্ষ করা যায়।


(3)প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ ও প্রাকৃতিক সেতু (Natural Tunnel and Natural Bridge) : কার্স্ট অঞ্চলের ক্ষয়কার্যের শেষ পর্যায়ে ধসের জন্য যেমন উভালা সৃষ্টি হয় তেমনি ভূগর্ভস্থ নদীগুলি প্রস্রবণের আকারে ভূপৃষ্ঠে দেখা যায়, এদের রাইস বা রিসারজেন্ট বলে। ধসের পরে সুড়ঙ্গের অবশিষ্ট অংশকে স্বাভাবিক সুড়ঙ্গ বলে। মধ্যপ্রদেশের মারাদেও পর্বতে স্বাভাবিক সুড়ঙ্গ লক্ষ করা যায়। ভারজিনিয়া রাজ্যের প্রাকৃতিক মুড়াটি প্রায় 300 মিটার দৈর্ঘ্য 40-42 মিটার প্রস্থ ও 35 মিটার উচ্চ এবং চওড়া 15 মিটার। মূলত চুনাপাথরের দ্রবণ কার্যের মাধ্যমে এই ধরনের সুড়ঙ্গ সৃষ্টি হয়। উপরের চুনাপাথরের স্তর দুপাশে অবনমিত হলে মাঝের অংশটি সাঁকোর মতো ভূমিরূপ গঠন করে। প্রধানত গহ্বর ও গুহাগুলির দুপাশ উন্মুক্ত হলে মাঝের শিলাস্তরটি প্রাকৃতিক সাঁকো গঠন করে। অর্থাৎ, প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গের ছাদ ধসে পড়তে থাকলে সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ক্রমশ কমতে থাকে। এভাবে কমতে কমতে ছাদের কিছুটা অংশ সেতুর মতো অবস্থান করে, একে প্রাকৃতিক সেতু বলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের উটা, মিসৌরি অঞ্চলে বহু প্রাকৃতিক সেতুর সৃষ্টি হয়েছে। 

‌● ভূগর্ভে গঠিত কার্স্ট ভূমিরূপ (Subterranean Karst Landforms)

(1) ভূগর্ভস্থ গুহা (Cave) : চুনাপাথর অঞ্চলে গুহা এক বিশেষ ভূমিরূপ। ভূগর্ভে ভৌম জলস্তরের কাছাকাছি কিংবা সামান্য নীচে জলের সঙ্গে কার্বনিক অ্যাসিডের দ্রবণ ক্রিয়ায় শিলাস্তরে যে গর্ত বা শূন্যস্থানের উৎপত্তি হয় তাকে গুহা বলে। অর্থাৎ জলের অনুপ্রবেশের এবং প্রবাহের ফলে শিলার দারণ ও ফাটল বরাবর অংশকে দ্রুত দ্রবীভূত এবং স্থানচ্যুত করে। এই প্রক্রিয়ায় জলপ্রবাহ পথে গুহার সৃষ্টি হয়। ভারতের দেরাদুন ও পাঁচসারিতে এই ধরনের গুহা দেখা যায়। সাধারণত চুনাপাথর ডলোমাইট, ক্যালসাইট প্রভৃতি শিলায় প্রবীভবনের ফলে বিভিন্ন আয়তনের গুহা সৃষ্টি হয়, এটি 10-100 মিটার ব্যাসার্ধ যুক্ত হয়।

 (2) গহ্বর (Cavern) : চুনাপাথরে গঠিত অঞ্চলে জলের দ্রবণ প্রক্রিয়ায় প্রভাবে ভুগতে সৃষ্ট ভৌমজল চলাচলের পথগুলিকে ভূগর্ভস্থ গুহা বলে। এই দ্রবণ কার্যের ফলে শিলান্তর ধসে গিয়ে গর্তের সৃষ্টি করে। এই গুহা আকারে অনেক বড়ো হলে তাকে ভূগহ্বর বলে। ফ্রান্সের গুয়ে বারজার (Goufre Berger) বিশ্বের গভীরতম গুহা। 

(3) স্ট্যালাকটাইট (Stalactite) : চুনাপাথর যুক্ত অঞ্চলের গুহায় কার্বনিক অ্যাসিড জলে মিশে চুনাপাথর গলে গেলে চুনাপাথরের জলীয় দ্রবণ গতি ধীরে ধীরে গুহার ছাদ থেকে গুহার মেঝেতে পড়তে থাকে। এই দ্রবণের জল গৃহার স্থান। থেকে মেঝেতে পড়ার আগে বাষ্পীভূত হলে দ্রবণের অবশিষ্টাংশ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জমতে জমতে স্তম্ভের আকারে ছাদ থেকে স্ট্যালাকটাইট m ঝুলতে থাকে। চুনাপাথরের গুহায় গঠিত এই ধরনের ঝুলন্ত স্ট্যালামাইট -- চুনাপাথরের স্তম্ভকে স্ট্যালাকটাইট বলে। উত্তরপ্রদেশের দেরাদুনের তপকেশর গুহায় এই ধরনের স্ট্যালাকটাইট শো যায়। 

(4) স্ট্যালাগমাইট (Stalagmite) : আবার ফাটলের নীচে গর্ভের মেঝেতে জল পড়ে এবং বাষ্পীভবনের ফলে এই স্থানে চুনের সঞ্জয় বাড়তে থাকে এবং পরবর্তী সময়ে এই অধঃক্ষেপিত অংশ স্তম্ভের আকারে মেঝে থেকে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। এদের স্ট্যালামাইট বলে। ভারতের মেঘালয় মালভূমির চেরাপুঞ্জির কাছে এই ধরনের স্ট্যালাগমাইট দেখা যায়। স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট 




(5) স্তম্ভ (Pillar): যখন গুহার ছাদ থেকে স্ট্যালাকটাইট ঝুলতে থাকে এবং গুহার মেঝে থেকে স্ট্যালাগনাইট উপরের দিকে উঠতে থাকে। এই দুই ধরনের ভূমিরূপ খুব ধীরে ধীরে সংঘটিত হয় এবং একটা সময় স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট জুড়ে গিয়ে স্তম্ভের সৃষ্টি করে। সাধারণত স্ট্যালাকটাইট ও স্ট্যালাগমাইট একই উল্লম্ব রেখায় অবস্থান বা গঠিত হয়। অনেকে এই স্তম্ভকে চুনাস্তস্ত বলে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ম্যামথ ও কার্লসবাড গুহায় এই ধরনের ভূমিরূপ লক্ষ করা যায়। 

(6) হেলিকটাইট (Helictite) : হেলিকটাইট চুনাপাথর যুক্ত অঞ্চলে চুনাপাথরের সঞ্চয়কার্যের ফলে গঠিত উল্লেখযোগ ভূমিরূপ। অনেক সময় চুনাপাথরের গুহায় ভ্রবণ কার্যের ফলে উৎপন্ন ক্যালসিয়াম কার্বনেট (CaCO3) গৃহায় নীচ থেকে উপরের দিকে কিংবা উপরের থেকে নীচের দিকে আবার অনুভূমিক বা তির্যকভাবে সঞ্চিত হয়ে প্রসারিত হলে যে ধরনের ভূমিরূপ সৃষ্টি হয় তাকে হেলিকটাইট বলে। মূলত গুহায় জলের সরবরাহ কম থাকার কারণে এই ধরনের ভূমিরূপ গড়ে ওঠে। অনেকে মনে করেন যে প্রবণ সঞ্চয়ের সময় যদি স্ফটিক রূপ ধারণ করে তাহলে সঞ্চয়ের অভিমুখ যে কোনে দিকে অগ্রসর হতে পারে। 

★ক্যারেনের শ্রেণিবিভাগ Classification of Karren 

চুনাপাথর অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠে অবস্থানরত ছোটো বড়ো বিভিন্ন ধরনের ভূমিরূপ গড়ে উঠতে লক্ষ করা যায়। ছোটো আয়তনের। ভূমিরূপগুলি সাধারণত ভূপৃষ্ঠে শিলার সঙ্গে বৃষ্টি জলের দ্রবণের ফলে উৎপত্তি লাভ করে। আবার বিভিন্ন আকৃতির আবদ্ধ নিম্নভূমি (enclosed depresions) গুলি সাধারণত বড়ো আয়তনের ভূমিরূপ হিসেবে পরিচিত। ছোটো আয়তনের ভূমিরূপগুলির মধ্যে অন্যতম হল ক্যারেন।

● ক্যারেন (Karren) : খাড়া ঢালযুক্ত চুনাপাথরের শিলাস্তরের উপর বৃষ্টির জল পড়লে, ঐ শিলাস্তরের উপর 1-2 সেমি ব্যাসের ছোটো ছোটো গর্ত তৈরি হয়। এই ধরনের গর্তকে 'রেন পিট (rain pit) বলে। বৃষ্টির জল যদি কোনো স্থানে জামে থাকে, তাহলে এ জমে থাকা জল রেন পিটের চারিদিকে প্রবণের কাজের দ্বারা স আঁচডের (grooves) মতো খাঁজ সৃষ্টি করে। অবাসি ভাষায় একে ল্যাপিস (lapies) বললেও জার্মান ভাষায় একে ক্যারেন বলে। ডুবিজ্ঞানী বোগলি 1960 সালে ক্যারেনের কালতিন্ন করেন। আবার আকৃতি অনুসারে ক্যারেন মোটামুটি চার প্রকারের হয়ে থাকে। নিম্নে এগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করা হল 

1. রিলেন ক্যারেন (Rillen Karren) : চুনাপাথরযুক্ত অঞ্চলে সংকীর্ণ নিম্নভূমির মধ্যবর্তী উচ্চভূমিগুলি সাধারণত খুব সংকীর্ণ ও খাড়া ঢালযুক্ত হয়। কিন্তু মাঝারি ঢালযুক্ত চুনাপাথর অঞ্চলে উপরের মাটি অপসারিত হলে, সূক্ষ অগভীর খাঁজের সৃষ্টি হয়। অতি ক্ষুদ্র জলধারার (rill) দ্রবণের ফলে, এই দ্রবণ গাঁজ (solution flute) গুলি সৃষ্টি হয়। এই ধরনের খাঁজকে রিলেন ক্যারেন বলে। 

2. রিলেন ক্যারেন (Rinnen Karren) : রিলেন খাঁজের এক বৃহৎ রূপ হল রিনেন ক্যারেন। এই ক্যারেনের দৈর্ঘ্য প্রায় 60 মিটার এবং গভীরতা প্রায় 50 সেমির মতো হয়ে থাকে। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের পর এই বড়ো খাঁজে জল ভরে গেলে এই ক্যারেনগুলি একটা নদীর আকার ধারণ করে। 

3. রান্ড ক্যারেন (Rund Karren) : চুনাপাথর সমৃদ্ধ অঞ্চলে, মৃত্তিকা স্তরের নীচে গোলাকৃতি প্রস্তরখণ্ড দ্বারা গড়ে ওঠা ভূমিরূপকে রান্ড ক্যারেন বলে। কোনো অঞ্চলে উপরের মাটির স্তর অপসারিত হলে, এই গোলাকার প্রস্তর খণ্ডগুলি মাটির উপর থেকে দেখা যায়। মাটির ভিতরে জলের অণুস্রবণের (percolation) ফলে এই ধরনের ক্যারেনের সৃষ্টি হয়। 

4. ক্লাঙ্কট ক্যারেন (kulft Karren): এটি হল একধরনের দ্রবণজাত বড়ো খাত। চুনাপাথর অঞ্চলে দারণ তল (Joint plane) যুক্ত শিলায় সব থেকে বেশি প্রবণ এই দুর্বল দারণ স্থানগুলিতে হয়ে থাকে। জলীয় দ্রবণের ফলে দারণ তলগুলি ক্রমশ চওড়া হতে থাকে। এই চওড়া ফাটলগুলিকে ক্লাফ্ট ক্যারেন বা গ্রাইক নামে পরিচিতি। এই ফাটলগুলি 2-4 মিটার প্রশ্ন এবং 1-5 মিটার গভীরতা প্রাপ্ত হতে পারে। যখন এই বড়ো আকৃতির ফাটলের দৈর্ঘ্য 10 মিটার এবং প্রস্থ 2-4 মিটার এবং গভীরতা 30-40 মিটার হয় তখন তাকে বোগাজ (bogoz) বলে। আবার দুটি গ্রাইকের মধ্যবর্তী অংশকে ক্লিন্ট (clint) বলে। ক্লিন্টগুলি ত্রিকোণাকার চূড়াবিশিষ্ট কিংবা চ্যাপ্টা আকৃতির হতে পারে। আবার ক্লিন্ট ও গ্রাইক দ্বারা আবরণ যুক্ত চুনাপাথরের অঞ্চলকে ক্যারেন ক্ষেত্র বা Karren Field বলে। উপরিউল্লিখিত ক্যারেন ছাড়াও আরো অনেকগুলি ক্যারেনের অস্তিত্ব রয়েছে সেগুলি হল—ওয়ান্ড (wand), হোল্ (hohl), মানডার (maander), ডেকেন্ (decken), হোলেন (hohlen), টিট্ (tritt), রেজেনরিনেন Vegenrinnen), স্পিটজ (spitz) এবং স্কিফুজেন (Schichtfugen) প্রভৃতি। 

ডোলাইন-এর শ্রেণিবিভাগ Classification of Doline
 
চুনাপাথর কিংবা চক্‌ সমৃদ্ধ অঞ্চলে দারণ তল (Joint plane) যুক্ত শিলাস্তরে ভূপৃষ্ঠ জলপ্রবাহ (surface run off) কিংবা ভৌমজলের প্রবাহ দ্বারা বিভিন্ন ধরনের ভূমিরূপ দেখা যায়। ভূমিরূপগুলি দুই ধরনের যথা ভূপৃষ্ঠের ভূমিরূপ (surface land forms) এবং ভূ-অভ্যন্তরীণ ভূমিরূপ (underground landforms)। আবার আয়তনের অভ্যন্তরীণ ভূমিরূপকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা— ক্ষুদ্র আয়তনের ভূমিরূপ এবং বৃহৎ আয়তনের ভূমিরূপ। বৃহৎ আয়তনের ভূমিরূপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ডোলাইন। 

■ ডোলাইন (Doline) : চুনাপাথরযুক্ত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে প্রবণ ও ক্ষয়কার্যের ফলে ছোটো ছোটো গর্ত বা সিঙ্কহোল কিংবা সোয়ালো হোলগুলি ক্রমশ আকারে বড়ো হয়ে, যে বড়ো বড়ো গর্তের সৃষ্টি করে, তাদের ডোলাইন বলে। এটি এক ধরনের আবদ্ধ নিম্নভূমি (enclosed depressions)। অনেকের মতো চুনাপাথর অঞ্চলে যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিত্র বা গর্তের সৃষ্টি হয়। এই সমস্ত ছিদ্র দিয়ে নদী কিংবা ভূপৃষ্ঠের জল ভূঅভ্যন্তরে প্রবেশ করে, ভূঅভ্যন্তর ভাগ দিয়ে ঢাল অনুসারে কয়েক কিমি। প্রবাহিত হওয়ার পর পুনরায় ভূপৃষ্ঠে এসে পড়ে। এইভাবে ভুগর্ভে নদীর জল অন্যত্র চলে যাওয়ার ফলে নদী উপত্যকা শুষ্ক। (dry valley) উপত্যকায় পরিণত হয়। পুনরায় অধিক বৃষ্টিপাতের দরুন জল ছিদ্রপথে প্রবেশ করতে না পেরে শুদ্ধ উপভাষা দিয়ে প্রবাহিত হয়। যুগোশ্লাভিয়ার কার্স্ট অঞ্চলে এই ছিদ্রগুলিকে ডোলাইন বলে। ডোলাইনের গর্তগুলি ভূ-অভ্যন্তরে বিভিন্ন আকার ধারণ করে। কখনো ত্রিকোণাকার (triangle shape) কিংবা চোরে আকৃতি বা বাটি আকৃতি মতো হয়ে থাকে। ছিদ্র বা গর্তে ধারগুলি অনাবৃত শিলা (bare rock) দ্বারা গঠিত হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে উদ্ভিদ দ্বারা আবৃত থাকে। গর্ভের মুখগুলি সাধারণত ডিম্বাকার কিংবা গোলাকার আকার ধারণ করে। ডোলাইনের গভীরতা 1/2-1000 মিটার হয়ে থাকে। সেইসঙ্গে ব্যাস 10-1000 মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। কার্স্ট অঞ্চলে ডোলাইনগুলি আলাদা আলাদাভাবে অবস্থান করলেও বাইরে থেকে ডোলাইনগুলিকে দলবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে বলে মনে হয়। কোনো অঞ্চলের অসংখ্য ডোলাইনের উপস্থিতি ভূপৃষ্ঠ অসংখ্য ছিদ্রের চেহারা নেয়। ডোলাইন গঠনে কী ধরনের প্রক্রিয়া কাজ করছে তার উপর ভিত্তি করে ভোলাইনকে ১টি ভাগে ভাগ করা যায়। নীচে সেগুলি সম্বন্ধে আলোচনা করা হল— 

(1) দ্রবণজনিত ডোলাইন (Solution Doline): চুনাপাথর যুক্ত অঞ্চলে যেখানে শিলার দারণতলগুলি পরস্পর পরস্পরকে ছেদ করে, সেখানে দারণতলগুলি ক্রমশ চওড়া হতে থাকে। এই তল বা ফাটল বরাবর দ্রবীভূত পদার্থ (solute) এবং জলীয় দূষণের অবশেষ নীচের দিকে নেমে এসে নিম্নভূমির (depression) সৃষ্টি করে। এইভাবে ভূপৃষ্ঠের কিছু অংশ যদি বসে যায়, তাহলে স্বাভাবিক কারণে সেখানে জলধারাগুলি প্রবাহিত হয়। অতিরিক্ত জলপ্রবাহের ফলে ডোলাইনের আয়তন বৃদ্ধি পায়। এইভাবে দারণ বরাবর দ্রবণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ডোলাইন গঠিত হতে পারে। এই ডোলাইনের ধারগুলি অনেক ক্ষেত্রে উদ্ভিদ দ্বারা ঢাকা থাকে, এবং দ্রবণ পদার্থ নীচে সজ্জিত হয়ে অপ্রবেশ্য মৃত্তিকার স্তর গঠন করে যার ফলস্বরূপ একটি হ্রদ গঠিত হয়। মূলত এই ডোলাইনগুলি বাটি (bowl) আকার ধারণ করে। অনেকক্ষেত্রে ডোলাইনের চারপাশে ঢাল সমান না। হওয়ায় তাকে অপ্রতিসম ডোলাইন (asymmetric doline) বলে। এই ধরনের ডোলাইনে টেরারোসা (terra rossa) মাটি দেখতে পাওয়া যায়। 

(2) ধসজনিত ডোলাইন (Collapse Doline) : কার্স্ট অঞ্চলে ভূগর্ভের যদি গুহা থাকে, তাহলে ডোলাইনগুলি অনেক গভীরতা পর্যন্ত বিস্তৃত হতে থাকে। ফলে গুহার ছাদ ভেঙে ধসে পড়লে যে ডোলাইনের সৃষ্টি হয় তাকে ধসজনিত ডোলাইন বলে। এই অংশে গুহার নীচে বেশি জল থাকলে হ্রদ সৃষ্টি হতে পারে। এই ধরনের ডোলাইনের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল যুগোশ্লাভিয়ার ভেলিকা (velika) ডোলাইন। যার গভীরতা 164 মিটার এবং প্রশ্ন প্রায় 500 মিটার। আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চলে এই ডোলাইনগুলি চারপাশের ঢাল চোঙের ন্যায় (funnel shape) কিন্তু শুষ্ক অঞ্চলে খাড়া ঢাল বহু দিন পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকে। 

(3) অবনমনজনিত ডোলাইন (Subsidence Doline) : সাধারণত চুনাপাথরযুক্ত অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠে উপরের অবস্থানরত মৃত্তিকা কিংবা শিলাচূর্ণের স্তর আলগা হয়ে গেলে তা অনেক সময় ধীরে ধীরে অবনমিত হয়ে অবনমনজনিত ডোলাইন সৃষ্টি করে। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের উপর যেখানে জলের প্রবাহ কিংবা হিমবাহ জমা হওয়ায়, চুনাপাথরের দারণ তলগুলি প্রথমে দ্ররণ প্রক্রিয়ায় চওড়া ফাটলে পরিণত হয় এবং পরবর্তী সময়ে নীচের দিকে বসে যাওয়ার ফলে এই ধরনের ডোলাইনের উৎপত্তি। ঘটে। এই ধরনের ডোলাইন হল ইয়র্কশয়ারের ক্লাভেন যে সব শেক্‌হোল ( Shakehole) রয়েছে সেগুলি। 

(4) নীচে অবস্থিত কাস্টীয় ডোলাইন (Subjacent Karst Doline): যে সমস্ত স্থানে চুনাপাথরের উপরে বেলেপাথর (sandstone) কিংবা কাদাপাথর (mudstone) জাতীয় শিলার অবস্থান হয়েছে সেখানে এই ধরনের ডোলাইনের উৎপত্তি ঘটেছে। সাধারণত ভূ-অভ্যন্তরে গুহার ছাদ ভেঙে পড়লে, উপরের শিলাস্তরগুলি ভারসাম্য না রাখতে পেরে ভেঙে পড়ে। তখন তার নীচে চুনাপাথরের স্তর থাকলেও ডোলাইনের মুখটি অন্য কোনো শিলাস্তরের উপর অবস্থান করে। 

(5) নদী অরণজনিত ডোলাইন (Stream Sink Doline): যখন ভূপৃষ্ঠে কোনো অবস্থানরত পলির স্তরকে ছেদ করে কোনো নদীপ্রবাহ ভূ-অভ্যস্তরে চুনাপাথর স্তরে প্রবেশ করে তখন তাকে নদী অবতরণজনিত ডোলাইন বলে। এই ধরনের ডোলাইনে নদীগুলি মাটির নীচে সুড়ঙ্গ তৈরি করে। নদীর জলপ্রবাহ শুধুমাত্র ভ্রবণ প্রক্রিয়াকে সাহায্য করে তা নয়। ভূ-অভ্যন্তরে সুড়ঙ্গ গঠনে সাহায্য করে। ফলে সুড়ঙ্গগুলি মাটির নীচে বিস্তার লাভ করে। অনেকগুলি সুড়ঙ্গ একত্রে গহ্বরে। গিয়ে পড়ে। সুড়ঙ্গগুলি ডোলাইনে যেখানে মিলিত হয়, সেই অংশকে পোনর (ponor) বলে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Middle post ad 01