welcome to mygeo.in Indian no 1 geography based website in Bengali

ক্ষয়চক্র [Cycle of Erosion]


● ক্ষয়চক্রের ধারণা (Concept of Cycle of Erosion)

 ভূমিরূপবিদ্যার আলোচনায় ক্ষয়চক্র একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। ক্ষয়চক্রকে বাদ দিয়ে ভূমিরূপবিদ্যাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই ভূমিরূপবিদ্যায় ক্ষয়চক্রের অবদান অনস্বীকার্য। আমাদের চারপাশে বিভিন্ন ধরনের ভূমিরূপ আমরা দেখতে পাই সেইসঙ্গে এটাও দেখি যে কোথাও ভূমিরূপ উঁচু আবার কোথাও ভূমিরূপ নীচু কিংবা কোথাও ভূমিরূপ মাঝারি উচ্চতাযুক্ত। এই ভূমিরূপগুলির অবস্থান আর্দ্র বা শুদ্ধ কিংবা নাতিআর্দ্র বা প্রায় শুষ্ক জলবায়ুযুক্ত অঞ্চলে। ভূপৃষ্ঠের ওপর অবস্থানরত সমস্ত ধরনের ভূদৃশ্যাবলি কিংবা ভূমিরূপের একটি জীবন ইতিহাস (life history) রয়েছে। আগে মনে করা হত প্রত্যেকটি ভূমিরূপের মধ্যে আলাদা আলাদা জীবন ইতিহাস রয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে জানা গেল যে ভূপৃষ্ঠে অবস্থানরত ভূমিরূপগুলি আলাদা নয়, সামগ্রিক ভূমিরূপের এক একটি অংশ বিশেষ। ভূপৃষ্ঠে আমরা কোথাও পর্বত, মালভূমি, সমভূমি আবার কোথাও শত্রু বা গম্বুজ আকৃতির ভূমিরূপ দেখতে পাই। ভূপৃষ্ঠে কোথাও ভূমির ঢাল খাড়াই (steep), মাঝারি (moderate) কিংবা মৃদু (gentle) ঢালযুক্ত ভূমিরূপ দেখতে পাই। সাধারণত যে কোনো অঞ্চলের ভূমিরূপের একটি সুনির্দিষ্ট জীবন ইতিহাস রয়েছে (a landscape has a definite life history) এবং তার বিকাশ বিবর্তনের মাধ্যমেই সম্ভব। জীবজগতে প্রতিটি উদ্ভিদ কিংবা প্রাণীর বিভিন্ন অবস্থা (যৌবন, পরিণত, বার্ধক্য) যুগ যুগ ধরে বিবর্তিত হচ্ছে ঠিক তেমনি প্রতিটি ভূমিরূপ বিভিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে বিবর্তন ঘটিয়ে শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। অর্থাৎ প্রত্যেক ভূমিরূপের যে জীবন ইতিহাস রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে ভূমিরূপের পর্যায়ক্রমে এবং শ্রেণিবন্ধভাবে পরিবর্তনের সঙ্গ্যে বিবর্তন ঘটে চলেছে। এই বিবর্তন প্রাথমিক অবস্থা থেকে ধারাবাহিকভাবে ভূমিরূপ সৃষ্টির দ্বারা বার্ধক্য পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিখ্যাত জীববিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের (Charles Darwin) 1859 সালে 24 নভেম্বর প্রকাশিত “On the Origin of Species" গ্রন্থ যেমন সারা বিশ্ব নাড়িয়ে দিয়েছিল, ঠিক তেমনি বিখ্যাত আমেরিকান ভূমিরূপবিজ্ঞানী উইলিয়াম মরিস, ডেভিস (William Morris Davis, 1899) চার্লসের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ভূমিভাগের বিবর্তন ধারণাটি প্রবর্তন করেন যাকে ক্ষয়চক্র সম্পর্কিত ধারণা (Concept of Cycle of Erosion) বলে। 

● সংজ্ঞা (Definition)

 তৃ-আন্দালনের ফলে ধীরে ধীরে তুমি উঁচু হয়ে ওঠে, সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির দ্বারা (জল, হিমবাহ, বায়ু, তরঙ্গ, উন্নতা) ভূমিভাগ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে সমতলভূমিতে পরিণত হওয়া, আবার পুনরায় ভূ-আন্দোলনের ফলে উত্থিত হানা যে প্রক্রিয়া চক্রাকারে চলতে থাকে তাকে ক্ষয়চক্র (cycle of erosion) বলে। ডেভিসের মতে (W. M. Davis, 1899) যে কোনো ভূমিভাগের একটি সুনির্দিষ্ট জীবন ইতিহাস রয়েছে, যার মধ্য দিয়ে ক্রমপর্যায়ে ভূমিভাগটির নিয়মিত পরিবর্তনগুলি প্রকাশ পায় এবং ভূমিভাগটি প্রারম্ভিক অবস্থা থেকে কতকগুলি অন্তর্বর্তী
অবস্থার মধ্য দিয়ে শেষে পরিণত পর্যায়ে এসে পৌঁছোয় (a landscape has a definite life history during which it shows a series of gradual changes, whereby the initial form passes through a series of sequential forms to an ultimate form) 1 অর্থাৎ ভৌগোলিক ক্ষয়চক্র বলতে সেই ফ্যচক্রকে বোঝায়, যার মধ্য দিয়ে ভূমিরূপের বৈচিত্র্যের দ্বারা একটি উত্থিত ভূমিভাগের রূপান্তর ঘটে এবং শেষ পর্যায়ে তা সমপ্রায় ভূমিতে পরিণত হয় (geographical cycle is the period of time during which an uplifted land mass undergoes its transformation by the process of land sculp ture ending into a low featureless plain-a peneplain) অর্থাৎ কোনো ভূমিরূপের সৃষ্টি বা ধ্বংস চক্রের মাধ্যমে আবর্তিত হলে সেই প্রক্রিয়াকে কয়চক্র বলে। আবার ক্ষয়চক্রার অন্যভাবে বলা যায় যে সমুদ্র সমতল থেকে উত্থিত কোনো ভূমিভাগ প্রাথমিক অবস্থায় ক্ষয়কার্য সম্পাদন করে ক্রমপর্যায়ে যৌবন ও পরিণত অবস্থার মধ্য দিয়ে পরিণত পর্যায়ে অর্থাৎ ক্ষয়ের শেষ সীমায় উপনীত হয়। এইভাবে কোনো ভূমিরূপে যদি বারবার চক্রাকারে ক্ষয় ও পুনরুত্থান চলতে থাকে তাহলে তাকে ক্ষয়চক্র বলে। ক্ষয়চক্র বিষয়টি বিস্তৃতভাবে বলা যায় যে, ভূ-আন্দোলনের ফলে কোনো অঞ্চলের ভূমিভাগ সমগ্র সমতল থেকে উত্থিত হলে সেখানে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি ক্ষয়কার্য শুরু করবে। এই ক্ষয়কার্যের ফলে উচ্চভূমিভাগ ক্রমশ অবনত হতে থাকবে। এই ক্ষয়কার্যের প্রক্রিয়াটি চলতে থাকবে যতক্ষণ না পর্যন্ত ভূমিভাগটি সমপ্রায় ভূমিতে অর্থাৎ সমুদ্র সমতলে পৌঁছায়। আবার ভূমিটি ভূ-আন্দোলনের ফলে উত্থিত হলে পুনরায় আগের মতো ক্রয়কার্য করতে থাকবে। ভূমিভাগের এই ধরনের উত্থান ও ক্ষয়কাজের প্রক্রিয়া চক্রাকারে এইস্থানে ঘটে বলে একে ক্ষয়চক্র বলে। 

● ক্ষয়চক্রের নিয়ন্ত্রক (Controlling Factors of Cycle of Erosion)

 ভেডিসের মতে কোনো একটি অঞ্চলের ক্ষয়চক্রের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য সেই অঞ্চলের গঠন (structure), (process) এবং পর্যায় বা সময়ের (stages) উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ ভূমিরূপ হল গঠন, প্রক্রিয়া এবং পর্যায় বা অবস্থার সামগ্রিক ফল (landscape is a function of structure, process and stage) এই তিনটি নিয়ন্ত্রকের উপর নির্ভর করে বিশেষ বিশেষ ভূমিরূপ পদ্ধতিগুলির কাজের ফলে বিভিন্ন অধ্যায় গড়ে ওঠে। ভূপৃষ্ঠে নদী, হিমবাহ, বায়ু, সমুদ্র তরা প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তিগুলি ভূমিরূপের পরিবর্তন সাধন করে। তাদের নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ক্ষয় এবং সায়কার্যের ফলে নদীর বিভিন্ন পদ্ধতির সাহায্যে পৃথিবী পৃষ্ঠের বৃহত্তম অংশের পরিবর্তন ঘটেছে। নীচে এই নিয়ন্ত্রকগুলি আলোচনা করা হল-- 

1) গঠন (Structure) 

গঠন শব্দটি ডেভিস বৃহত্তর অর্থে ব্যবহার করেছিলেন। কোনো অঞ্চলে ভূমিরূপ গঠনে ভূতাত্ত্বিক গঠন সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে। ডেভিস গঠন বলতে শিলার গঠন তথা কাঠিন্য (hardness), সংযুক্তি (composition), ভাঁজ (folding), চ্যুতি (faulting), শিল্পা লক্ষণ (lithology), নতি (dip), প্রবেশ্যতা (permeability) প্রভৃতির সম্মিলিত অবস্থাকে বুঝিয়েছেন। সমস্ত ভূমিভাগের মধ্যে ঘন সন্নিবিষ্ট ভঙ্গিল পার্বত্য অঞ্চল কিংবা একদিক হেলে থাকা পাললিক শিলা গঠিত অঞ্চলে ভূমিরূপের সঙ্গে ঐ অঞ্চলে অভ্যন্তরীণ ভূতাত্ত্বিক গঠনের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। আবার কোনো স্থানে কঠিন ও কোমল শিলা পাশাপাশি অবস্থানের ফলে কোমল শিলাটি ক্ষয়ে যাওয়ায় কঠিন শিলাটি উচ্চভূমিরূপে অবস্থান করে। আবার মরু অঞ্চলে জলের অভাবে দ্রবণ প্রক্রিয়া খুব সামান্য হয় বলে চুনাপাথরের ভূমিরূপ উচ্চভূমিরূপে অবস্থান করে। কিন্তু আর্দ্র অঞ্চলে দ্রবণ প্রক্রিয়া ভালোভাবে হয় বলে, নদী গভীর ও বিস্তৃত উপত্যকা গঠন করে। অন্যদিকে গ্রানাইট গঠিত অঞ্চলে উচ্চভূমি দেখতে পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে একনত গঠনযুক্ত অঞ্চলে পরিণত ক্ষয়কার্যের ফলে ভূগুশ্রেণির ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। আবার কোনো স্থানে চ্যুতি সৃষ্টি হলে ভৃগু বা অতি খাড়াই ঢাল উৎপন্ন হয়। ভাজ গঠনযুক্ত অঞ্চলে বৈপরীতা ভূমিরূপের সৃষ্টি হয়। আবার যদি শিলাস্তর প্রবেশ্য প্রকৃতির হয়, তবে সেখানে জলধারার প্রবাহ কম হয় বলে শিলাস্তর কম ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। কিন্তু জিপসাম কিংবা চুনাপাথরযুক্ত অঞ্চলে ভৌমজলের দ্বারা ক্ষয়কার্য বেশি লক্ষ করা যায়। যাই হোক ভূতাত্ত্বিক গঠনের উপর গড়ে ওঠা ভূমিরূপের পর্যায়ক্রমিক বিকাশ সাধন বিভিন্ন প্রকার পর্যায়ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গড়ে ওঠে।

2) প্রক্রিয়া (Process) :

 ক্ষয়চক্রের অন্যতম নিয়ন্ত্রক হল প্রক্রিয়া। এখানে প্রক্রিয়া বলতে ডেভিস সেইসব প্রাকৃতিক শক্তির কথা বলেছেন যা কোনো বস্তুকে অবলম্বন করে কর ও বহনের মাধ্যমে নিয়মিত ভূমিরূপের পরিবর্তন ঘটিয়ে চলেছে। এখানে ভূপৃষ্ঠের উপর অনবরত ক্রিয়াশীল আবহবিকার (weathering), নদী জলপ্রবাহ (river running water), হিমবাহ (moving ice), বায়ুপ্রবাহ (wind), পুঞ্জিত ক্ষয় (mass wasting), সমুদ্রতরা (ocean waves), সমুদ্রস্রোত (ocean current) প্রভৃতিকে প্রক্রিয়া হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ভূমিরূপ পরিবর্তনে প্রক্রিয়াও যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। অন্যভাবে আবার ভূমিরূপ পরিবর্তনে শক্তি বা প্রক্রিয়াকে দুটি স্বতন্ত্র ভাগে ভাগ করা যায় যথা (a) ভূ-অভ্যন্তরস্থ প্রক্রিয়া বা শক্তি এবং (b) ভূপৃষ্ঠস্ব প্রক্রিয়া। ভূ-অভ্যন্তরস্থ প্রক্রিয়া বা শক্তির অন্তর্গত বিষয়গুলি হল অগ্ন্যুলান এবং বিপর্যয় শক্তি যা পর্বত, মালভূমি কিংবা পাহাড় নির্মাণের মাধ্যমে ভূপৃষ্ঠে বিভিন্ন ধরনের বন্ধুরতাযুক্ত ভূমিরূপ সৃষ্টি করে। একইভাবে ভূপৃষ্ঠস্থ প্রক্রিয়া বা শক্তির বিষয়গুলির দ্বারা ভূমিভাগ ক্ষরীভূত হয় এবং ক্ষয়জাত পদার্থগুলি বহনের প্রক্রিয়ায় দ্বারা বিভিন্ন ধরনের ভূমিরূপ গঠন করে। প্রত্যেক ভূমিরূপ পরিবর্তনকারী শক্তি নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের দ্বারা বিভিন্ন ভূমিরূপ গড়ে তোলে। আবার স্থানীয় পরিবেশের বিভিন্নতার জন্য প্রাকৃতিক শক্তিগুলি বিভিন্নভাবে কাজ করে ভূমিরূপ গঠনে বিভিন্নতা সৃষ্টি করে। প্রত্যেক ভূমিরূপ পরিবর্তনের শক্তিগুলি বিভিন্ন ধরনের ক্ষয় ও সঞ্চয়কার্যের পদ্ধতির সাহায্যে ভূমিরূপের পরিবর্তন করে। যেমন নদী তার বিভিন্ন ক্ষয়কার্যের পদ্ধতির দ্বারা উচ্চগতিতে গিরিখাত, ক্যানিয়ন, জলপ্রপাত এবং সঞ্চয়কার্যের পদ্ধতির দ্বারা পলল ব্যজনী, প্লাবন সমভূমি, বদ্বীপ প্রভৃতি ভূমিরূপ সৃষ্টি করে। একইভাবে হিমবাহ, বায়ু, সমুদ্রতরণা প্রভৃতি শক্তিগুলির দ্বারা বিভিন্ন ভূমিরূপের পরিবর্তন সহ সৃষ্টি হয়, যেমন সার্ক, ঝুলন্ত উপত্যকা, ড্রামলিন, গ্রাবরেখা, ব্রোহোল, স্ট্যাক, স্ট্যাম্প, পুরোদেশীয় বাঁধ, সৈকত, ড্রেইকান্টর, ইয়ারদাঙ, জুইগেন, গৌর, বালিয়াড়ি প্রভৃতি। এই সমস্ত প্রক্রিয়ার সামগ্রিক ফলাফল হিসেবে স্বাভাবিকভাবে ভূপৃষ্ঠের উচ্চতার হ্রাস বা বৃদ্ধি ঘটে। 

3) পর্যায় বা সময় (Stage):

 ক্ষারচক্রের সর্বশেষ নিয়ন্ত্রক হল পর্যায় বা অধ্যায় বা অবস্থা বা সময়। ডেডিস ভূমিরূপ বিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ের বিভিন্ন ভাগকে বোঝান এবং এক একটি একককে একক অবস্থা বলে চিহ্নিত করেন। এই প্রসঙ্গে ডেভিস ক্ষয়চক্রের মোট সময়কে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন যথা—যৌৱন (youth), পরিচত (mature) এবং বার্ধক্য (old)| গঠন এবং প্রক্রিয়া যেমন ক্ষয়চকে লক্ষ করা যায় তেমনি পর্যায়কে লক্ষ করা যায় না। কিন্তু ডেভিস সময়ের ভিত্তিতে ক্ষয়চক্রের বিভিন্ন অবস্থা সূচিত করেছেন। ডেভিসের মতে প্রত্যেক ভূমিরূপেরই একটি নির্দিষ্ট জীবন ইতিহাস আছে। যখন কোনো নবউত্থিত ভূমি তরুণ অবস্থায় প্রবেশ করে, বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিণত অবস্থা প্রাপ্ত হয়। সেইসঙ্গে সবশেষ অবস্থায় প্রায় সমতল ভূমিরূপে পরিণত হয়। যদি না এই ভূমিভাগে ভূ-আন্দোলন সমুদ্রপৃষ্ঠের পরিবর্তন বা জলবায়ুর কোনোরূপ পরিবর্তন না ঘটে। ডেভিস মানবজীবনের সঙ্গে সংগতি রেখে ভূমিভাগের বিবর্তনকে ওটি পর্যায়ে বিভক্ত করে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ভূমিরূপের বর্ণনা করেছেন। তরুণ অবস্থায় নবউত্থিত ভূমিরূপের পরিবর্তন শুরু হয় এবং পরিণত পর্যায়ে সর্বাপেক্ষা ভূমিরূপ লক্ষ করা যায় এবং ভূমিরূপের ধ্বংসকার্য শুরু হয়। পরিণত অবস্থায় ভূমিভাগ প্রায় সমতল ভূমিতে পৌঁছায়। এইভাবে কোনো ভূমিরূপ বিভিন্ন অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে তার পরিবর্তন সাধন করে। যদিও এই সমস্ত পর্যায়গুলি পর্যায়ক্রমিক সময়ের সাথে সম্পর্কিত এবং বৃহৎ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে বলা যায় যে ক্ষয়চক্র পর্যায়ে পৌঁছোনোকে সময় নামে অভিহিত করা হয়। তবে তিনটি পর্যায়ে সময়গত বিস্তার সমান নাও হতে পারে। কিন্তু দুটি আলাদা অঞ্চলে ভূমিরূপ যদি একই ভূমিরূপ বিকাশের অধ্যায়ে অবস্থান করে তবে সেক্ষেত্রে দুটি অঞ্চল নির্দিষ্ট অধ্যায়ে পৌঁছাতে একই সময় লাগবে।

● ক্ষয়চক্রের প্রকারভেদ (Types of Cycle of Erosion)

 অন্যান্য বিষয়ের মতো ক্ষয়চক্রকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। ভূপৃষ্ঠে অবস্থানরত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক শক্তি বিভিন্নভাবে ক্ষয়কার্য চালায়। প্রত্যেকটি প্রাকৃতিক শক্তিই নিজস্ব প্রকৃতি অনুযায়ী ক্ষয়চক্র ক্রিয়া সম্পাদন করে। যেসব = প্রাকৃতিক শক্তি ক্ষয়কার্যের মাধ্যমে ভূমিভাগের পরিবর্তন ঘটায় সেগুলি মূলত 3টি জলবায়ু অঞ্চলে অবস্থান করে যথা আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল, শুষ্ক বা মরু জলবায়ু অঞ্চল এবং শীতল জলবায়ু অঞ্চল। এই তিনটি জলবায়ু অঞ্চলের মধ্যে যে সমস্ত প্রাকৃতিক ক্ষয়কারী শক্তিগুলি কাজ করে সেগুলি হল – (a) নদী তথা জলের দ্বারা নদীর স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র (normal cycle of erosion) বা নদীর ক্ষয়চক্র (fluvial cycle of erosion), (b) জলপ্রবাহের দ্বারা চুনাপাথরযুক্ত অঞ্চলে ক্ষয়চক্র (cycle of karstic erosion), (c) সমুদ্রতরঙ্গের দ্বারা উপকূল অঞ্চলে সামুদ্রিক ক্ষয়চক্র (cycle of marine erosion), (d) অঞ্চলে বায়ুপ্রবাহজনিত ক্ষয় (cycle of arid or aeolian erosion), এবং (e) শীতল জলবায়ু অঞ্চলে অত্যধিক তুষারপাতের ফলে হিমবাহের ক্ষাচক্র (cycle of glacier erosion)। 


● স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র (Normal Cycle of Erosion)

 পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রায় 70 শতাংশ ভূমির বিবর্তন সাধারণত নদীর স্বাভাবিক ক্ষয়কার্যের মাধ্যমে সংঘটিত হয় বলে একে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র বা নদীর ক্ষয়চক্র বলে। আৰ্দ্ৰ নাতিশীতোয় অঞ্চলে নদীর হ্যা এবং সঞ্জয়কার্যের ফলে ভূমিরূপের যে ধারাবাহিক ও পর্যায়ক্রমিক বিবর্তন ঘটে তাকে নদীর স্বাভাবিক ক্ষয়কার্য বলে। ভূপৃষ্ঠের বেশিরভাগ ভূমিরূপই নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে গড়ে উঠেছে। সেজন্য নদীর ক্ষয়কাজের ফলে ধীরে ধীরে পর্যায়ক্রমে যে ভূমিরূপ গড়ে ওঠে তাকে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র বলে। সমুদ্র থেকে উত্থিত কোনো ভূমিভাগ যখন নদনদীর ক্ষয়কার্যের ফলে প্রাথমিক অবস্থা থেকে নির্দিষ্ট ক্রম অনুসারে যৌবন, পরিণত অবস্থার মধ্যদিয়ে বার্ধক্য অবস্থায় অর্থাৎ ক্ষয়ের শেষ সীমায় পৌঁছোয় তাকে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র বলে (geographic cycle is that period of time in which an uplifted land area through weathering and erosion is converted into a plain surface without any characteristics.) 1 অর্থাৎ 1899 সালে আমেরিকার ভূগোলবিদ উইলিয়াম মরিস ডেভিস ক্ষয়চক্রের (cycle of erosion) যে ধারণা দেন তা তত্ত্বগতভাবে স্বাভাবিক ক্ষয়চ (normal cycle of erosion) নামে পরিচিত।

 ভূতাত্ত্বিক গঠন, পদ্ধতি ও পর্যায়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক (Inter Relation Among Geological Structure, Process and Stages) :


 ডেভিসের মতে প্রত্যেক স্থানেরই একটি স্বতন্ত্র জীবন ইতিহাস আছে, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধীর গতিতে আবর্তিত হয়। এইভাবে কোনো নর উত্থিত ভূমি বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিণত অবস্থায় উপনীত হয়ে বার্ধক্য অবস্থায় তা প্রায় সমতল ভূমিভাগে পরিণত হয় যদি না ভূমিভাগে ভূ-আন্দোলন, সমুদ্র জলপৃষ্ঠের পরিবর্তন বা জলবায়ুর কোনো পরিবর্তন ঘটে। ডেভিসের মতে কোনো স্থানের ভূমিরূপের বিবর্তন সেই স্থানের ভূতাত্ত্বিক গঠন, ভূমিরূপের পরিবর্তনের পদ্ধতি এবং অবস্থার উপর নির্ভর করে। ভূমিরূপের বিভিন্ন অবস্থা কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা মেনে আবর্তিত হয় না। কিন্তু প্রত্যেক অধ্যায়ের একটি প্রাথমিক, যৌবন, পরিণত এবং বার্ধক্য সহ এদের উপঅধ্যায়ও রয়েছে। প্রধানত নদীর বিভিন্ন পদ্ধতির দ্বারা ভূমিরূপের পরিবর্তন ঘটে। আবার কোনো পর্যায়ের স্থায়িত্বকাল প্রধানত কোনো অঞ্চলের ভূতাত্ত্বিক গঠন ও পদ্ধতির কাজের গতিবেগের উপর নির্ভরশীল। সাধারণত দুর্বল ভূতাত্ত্বিক গঠনযুক্ত অঞ্চলে ক্ষয়ের তীব্রতা বেশি হয়। ফলে নদী দ্রুত প্রাথমিক অবস্থা থেকে যৌবন, পরিণত কিংবা বার্ধক্য অবস্থায় পৌঁছোয়। কিন্তু ভূতাত্ত্বিক গঠন যদি কঠিন প্রকৃতির হয় তাহলে নদী ধীরে ধীরে প্রাথমিক অবস্থা থেকে বার্ধক্য অবস্থায় পৌঁছোবে অর্থাৎ দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। প্রত্যেক অধ্যায় বা পর্যায়ে নদী ঋতগুলি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিরূপ সৃষ্টি করে ফলে নদী বা নদী উপত্যাকা কোন অবস্থায় রয়েছে তাও সহজে নির্ণয় করা যায়। 

Middle post ad 01